Header Ads

জুলাইয়ের শহীদ আনাসের সেই অমর চিঠি পড়ে কেঁদেছে হাজারো মানুষ

          

জুলাইয়ের শহীদ আনাসের সেই অমর চিঠি পড়ে কেঁদেছে হাজারো মানুষ


 

মা, আমি মিছিলে যাচ্ছি। আর নিজেকে আটকে রাখতে পারছি না। সরি আব্বু, আপনার নিষেধ অমান্য করেই বের হলাম।"—এমন হৃদয়বিদারক চিঠি লিখে ঘর ছেড়েছিল দশম শ্রেণির ছাত্র শাহরিয়ার খান আনাস। যে নিজের প্রাণ উৎসর্গ করে হতে চেয়েছিল ‘জুলাই বিপ্লবের’ এক শহীদ। তার সেই ছোট্ট বার্তাটি হাজারো মানুষকে কাঁদিয়েছিল।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের কয়েক ঘণ্টা আগে রাজধানীর চানখারপুল এলাকায় পুলিশের গুলিতে নিহত হয় আনাস। তার বুকের বাঁ পাশ দিয়ে ঢুকে বুলেট পিঠ ভেদ করে বেরিয়ে যায়। রাজপথে মিছিলে অংশ নিয়ে শহীদ হয় এই কিশোর।

সেদিন সকালেই ঘুম থেকে উঠে গোসল করে চুপচাপ ঘর ছাড়ে আনাস। যাওয়ার আগে সে মা-বাবার জন্য একটি চিঠি লিখে রেখে যায় পড়ার টেবিলে।

চিঠিতে সে লিখেছিল,
"মা, আমি মিছিলে যাচ্ছি। আমি নিজেকে আর আটকাতে পারলাম না। সরি আব্বুজান, আপনার কথা অমান্য করে বের হলাম। স্বার্থপরের মতো ঘরে বসে থাকতে পারলাম না। আমাদের ভাইয়েরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কাফনের কাপড় মাথায় বেঁধে রাজপথে সংগ্রাম করছে। অকাতরে জীবন দিচ্ছে। একটি প্রতিবন্ধী কিশোর, ৭ বছরের শিশু, ল্যাংড়া মানুষ যদি সংগ্রামে নামতে পারে, তাহলে আমি কেন বসে থাকব?
একদিন তো মরতেই হবে। তাই মৃত্যুর ভয় করে ঘরে বসে না থেকে সংগ্রামে নেমে গুলিবিদ্ধ হয়ে বীরের মতো মৃত্যু বরণ করাই শ্রেয়। যে নিজের জীবন অন্যের জন্য বিলিয়ে দেয়, সেই-ই প্রকৃত মানুষ। আমি যদি বেঁচে না ফিরি, কষ্ট পেয়ো না, বরং গর্বিত হও। জীবনের সব ভুলের জন্য ক্ষমা চাই। – আনাস।"

এক ভার্চুয়াল আলোচনায় আনাসের মা স্মৃতিচারণ করে বলেন, কিছুদিন ধরেই আনাস মিছিলে যাওয়ার অনুমতি চাইছিল। কিন্তু তিনি এবং তার স্বামী তাকে বুঝিয়ে অপেক্ষা করতে বলেন। ঝুঁকি নিতে তারা চাননি। তবে ৫ আগস্ট সে কিছু না বলেই মিছিলে চলে যায়।

আনাসের বাবা, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী পলাশ বলেন, সেদিন তার ছুটির দিন ছিল। তিনি ঘুম থেকে ওঠেন বেলা ১১টার দিকে। তখনই খবর পান, আনাস মিছিলে গেছে। আশ্চর্য হলেও তিনি তখন রাগ করেননি।

তিনি বলেন, "আমরা দ্রুত ছুটে যাই হাসপাতালে। সেখানে একটি টেবিলে এক তরুণের চিকিৎসা চলছিল। দূর থেকে দেখেই মনে হলো ওটা আমার আনাস। ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরতে গেলে একজন বললেন, ‘এটা আপনার সন্তান নয়। আপনার ছেলেকে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।’ আমি জিজ্ঞেস করলাম—ভেতরে কোথায়? তখন তিনি বলেন, ‘কেঁচি গেটের ভেতরে।’ এই কথা শুনেই আমি কেঁপে উঠি। কারণ আমি জানি, কেঁচি গেটের ভেতর শুধু মরদেহই রাখা হয়। পরে গেট খুললে আমি ছুটে গিয়ে দেখি, আমার আনাস নিথর পড়ে আছে।”

এদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট রাজধানীর চানখারপুলে গুলি করে ৬ জনকে হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান হাবিবসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের শুনানি শেষ হয়েছে।

এই মামলার আদেশের জন্য আগামী ১৪ জুলাই দিন ধার্য করেছেন বিচারপতি গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। মামলায় প্রসিকিউশন পক্ষে শুনানি করেন প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম ও গাজী এইচ তামিম।

এই মামলায় পলাতক চার আসামিকে হাজির হতে গত ৩ জুন পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। পলাতক আসামিরা হলেন:

  • ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান

  • সাবেক যুগ্ম কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী

  • রমনা অঞ্চলের সাবেক অতিরিক্ত উপকমিশনার শাহ্ আলম মো. আখতারুল ইসলাম

  • রমনা অঞ্চলের সাবেক সহকারী কমিশনার মোহাম্মদ ইমরুল

মামলায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আমলে নেয় ২০২৫ সালের ২৫ মে।

শাহরিয়ার খান আনাস শুধু একজন ছাত্র ছিল না, ছিল এক সংগ্রামী আত্মা। তার সাহসিকতা ও আত্মত্যাগ আজও প্রজন্মকে প্রশ্ন করে—আমরা কী করছি ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াতে?

No comments

Powered by Blogger.