শুল্ক অনিশ্চয়তায় ঝুঁকিতে ১০ লাখ পোশাক শ্রমিক
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ‘রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ’ বা পাল্টা শুল্ক আরোপের কারণে দেশের তৈরি পোশাক খাত বড় ধরনের অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে। দেশটির সঙ্গে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের আলোচনায় এখনো উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় উদ্যোক্তাদের উদ্বেগ আরও বেড়েছে। তাঁদের আশঙ্কা, যুক্তরাষ্ট্রে ৩৫ শতাংশ শুল্ক কার্যকর হলে বাংলাদেশের পোশাক খাত আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হারাবে। এতে করে রপ্তানিকারকদের অনেককে মার্কিন বাজারে পণ্য পাঠাতে ৫০ শতাংশের বেশি শুল্ক দিতে হবে।
বিশ্লেষক ও রপ্তানিকারকদের মতে, এই পরিস্থিতি ছোট ও মাঝারি পোশাক কারখানাগুলোর অস্তিত্ব সংকটে ফেলতে পারে। সম্ভাব্যভাবে সহস্রাধিক কারখানা বন্ধ হয়ে যেতে পারে এবং অন্তত ১০ লাখ শ্রমিক বেকার হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন। তৈরি পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা গণমাধ্যমে দেওয়া প্রতিক্রিয়ায় এই শঙ্কার কথা জানিয়েছেন।
তাঁদের মতে, বাড়তি শুল্কের ফলে দেশের উদ্যোক্তারা ক্রয়াদেশ হারাতে পারেন এবং ভারত, পাকিস্তান ও ভিয়েতনামের মতো বড় প্রতিযোগীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবেন না। এই পরিস্থিতিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তৃতীয় দফার বৈঠকের প্রস্তুতি নিচ্ছে। মন্ত্রণালয় ইতিমধ্যে বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে আলোচনায় বসেছে। সরকারের ধারণা, আলোচনা দীর্ঘায়িত হলেও ইতিবাচক ফল পাওয়া যাবে।
ব্যবসায়ীরা আশা করছেন, সরকার দর-কষাকষিতে আরও জোরালো পদক্ষেপ নেবে। প্রয়োজনে যুক্তরাষ্ট্রে লবিইস্ট নিয়োগ ও দ্বিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে শুল্ক হ্রাসে উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তাঁরা। তবে তাঁদের মতে, শুধু বাণিজ্য নয়, আলোচনার বিষয়গুলো রাজনৈতিকও। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিদ্যমান নন-ডিসক্লোজার চুক্তিগুলো এই আলোচনায় একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে, যেটি অতিক্রমে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত প্রয়োজন।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র সরকার বাংলাদেশের ওপর ৩৫ শতাংশ বাণিজ্য শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছে, যা শুরুতে প্রস্তাবিত ৩৭ শতাংশ থেকে সামান্য কমানো হয়েছে। তুলনামূলকভাবে, ভিয়েতনাম ২০ শতাংশ, পাকিস্তান ২৯ শতাংশ শুল্কে আছে; তবে পাকিস্তান তা ১০ শতাংশে নামিয়ে আনার আশা করছে। তাই বাংলাদেশকে ১ আগস্টের আগে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি অনুকূল চুক্তি করতে হবে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের মোট রপ্তানি ছিল ৮৪০ কোটি ডলার, যার মধ্যে ৭৩৪ কোটি ডলার ছিল পোশাকপণ্য। একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে আমদানি হয়েছিল ২২০ কোটি ডলারের।
বিজিএমইএর সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেছেন, পাল্টা শুল্কের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যে বড় ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে লবিইস্ট নিয়োগের প্রস্তাব থাকলেও সরকার এখনো এ বিষয়ে আগ্রহ দেখায়নি। তবে আগামী সপ্তাহে তৃতীয় পর্যায়ের বৈঠকের পরিকল্পনা রয়েছে।
বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম জানান, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চলমান আলোচনা সঠিক পথে আছে এবং প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলাপ হয়েছে। তবে তিনি মনে করেন, শুধুমাত্র বাণিজ্যিক নয়, শুল্ক সুবিধা পেতে হলে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ জরুরি।
বিজিএমইএর জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ইনামুল হক খান বলেন, আলোচনায় ফল না এলে ৭ আগস্ট থেকে রপ্তানি করা পণ্যের ওপর বাড়তি শুল্ক গুনতে হবে। তিনি আরও জানান, ক্রেতারা এখনো পণ্য গ্রহণ নিয়ে নেতিবাচক কিছু বলেননি, কিন্তু সরকারকে জোরালোভাবে এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে। ৭ জুলাইয়ের পর যাঁরা রপ্তানি করেছেন, তাঁদের ঝুঁকিতে পড়তে হতে পারে।
বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক ও ট্যাড গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশিকুর রহমান তুহিন মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দর-কষাকষির মাধ্যমে বাড়তি শুল্ক কমানো গেলে বাজারে নতুন সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। অন্যথায় মার্কিন বাজার হারানোর আশঙ্কা রয়েছে, যা অর্থনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে।
তুহিন জানান, ৯ এপ্রিল অতিরিক্ত ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপের পর মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি ২২ শতাংশ কমে গেছে। প্রথম প্রান্তিকে এই হার ছিল গড়ে ১৬ শতাংশ। মার্কিন আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, মে মাসে পোশাক আমদানি নেমে এসেছে ৫২ কোটি ৩২ লাখ ডলারে, যা এপ্রিলের তুলনায় ২৮ শতাংশ কম।
যুক্তরাষ্ট্র ২ এপ্রিল বিশ্বের ৬০টি দেশের ওপর পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেয় এবং ৭ এপ্রিল থেকে তা তিন মাসের জন্য স্থগিত করে। এই স্থগিতাদেশের মেয়াদ শেষ হয়েছে ৯ জুলাই। এরপর ৮ জুলাই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন, ১ আগস্ট থেকে ৩৫ শতাংশ শুল্ক কার্যকর হবে।
শ্রমবাজারে বিরূপ প্রভাবের আশঙ্কা
এই পরিস্থিতির সবচেয়ে বড় আশঙ্কা শ্রমবাজারে। নতুন চাকরি না সৃষ্টি হয়ে বরং বিদ্যমান কাজ হারানোর ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। এতে দারিদ্র্য, বেকারত্ব, সামাজিক অস্থিরতা এবং অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা বাড়বে। পোশাক শিল্পের অন্তত এক হাজার ১০০টি ছোট ও মাঝারি কারখানায় কর্মরত ১০ লাখ শ্রমিক কর্মহীন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বছরে ৫ মিলিয়ন ডলারের কম রপ্তানি করে এমন ৪৫০টি ছোট কারখানায় গড়ে ৭০০ জন শ্রমিক কাজ করেন। অন্যদিকে, ৫ থেকে ২০ মিলিয়ন ডলার রপ্তানিকারী মাঝারি কারখানার সংখ্যা ৭০০, যেখানে গড়ে ১ হাজার শ্রমিক রয়েছেন। ছোট ও মাঝারি মিলে ১০ লাখের বেশি শ্রমিক কাজ করেন, যাঁদের বড় অংশ নারী।
বিজিএমইএ জানিয়েছে, বাড়তি শুল্ক আরোপ হলে এসব কারখানায় অর্ডার কমে যাবে। অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। উদ্যোক্তারা বলেছেন, ছোট ও মাঝারি কারখানাগুলোর অর্থনৈতিক সক্ষমতা কম। ফলে শুল্কের চাপ সামাল দিতে না পেরে তারা ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হবে।
সরকারের পদক্ষেপ ও কৌশল
সরকার সংকট থেকে উত্তরণের কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। এর অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ‘জিটুজি’ চুক্তির আওতায় প্রায় তিন লাখ টন গম আমদানির প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ, যার মূল্য রাশিয়া, ভারত বা ইউক্রেন থেকে আমদানির চেয়ে প্রতি টনে ২০-২৫ ডলার বেশি হতে পারে। এ ছাড়া বোয়িং বিমান, তুলা, গ্যাস টারবাইন, সেমিকন্ডাক্টর ও চিকিৎসা সরঞ্জামের আমদানিতেও শুল্ক সমন্বয়ের বিষয়টি বিবেচনায় রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ নীতিতে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি চাপ পড়েছে তৈরি পোশাক খাতে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রপ্তানি মাত্র ০.২৫ শতাংশ এবং দেশটির সঙ্গে বাণিজ্য উদ্বৃত্ত ৬.২ বিলিয়ন ডলার, তারপরও বাংলাদেশকে উচ্চ শুল্কের আওতায় আনা হয়েছে। আরএমজি খাত বাংলাদেশের মোট রপ্তানির ৮০ শতাংশের বেশি এবং এতে প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক কর্মরত।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের মতো বড় বাজারে প্রতিযোগিতার জন্য বাংলাদেশকে জরুরি ভিত্তিতে একটি কৌশলগত ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে—যাতে দেশের অর্থনীতি ও শ্রমিকদের জীবন-জীবিকা রক্ষা করা যায়।
No comments