Header Ads

গরুর অঙ্গও এখন মূল্যবান রপ্তানি পণ্য

 
        

গরুর অঙ্গও এখন মূল্যবান রপ্তানি পণ্য



কোরবানিসহ নানা উপলক্ষে গরু জবাইয়ের পর আমরা অনেক সময় ভাবি—অবশিষ্টাংশ হয়তো আর কোনো কাজে লাগে না। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, গরুর প্রায় প্রতিটি অংশেরই রয়েছে বিশেষ বাণিজ্যিক ব্যবহার। বিশেষ করে গরু ও মহিষের যৌনাঙ্গ—যা ‘বুলস্টিক’ নামে পরিচিত—তা দিয়ে তৈরি হচ্ছে কুকুরের খাবার, যার রয়েছে আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যাপক চাহিদা।

কোটি টাকার রপ্তানি

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ৯টি প্রতিষ্ঠান প্রক্রিয়াজাত বুলস্টিক রপ্তানির অনুমোদনপ্রাপ্ত। ২০২৩–২৪ অর্থবছরে প্রায় ১ লাখ ২ হাজার ৮৯ কেজি বুলস্টিক রপ্তানি হয়েছে, যার বাজারমূল্য প্রায় ২০ কোটি টাকা। এর আগের বছর, অর্থাৎ ২০২২–২৩ অর্থবছরে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৩৪ হাজার ৫৩৭ কেজি, যার মাধ্যমে আয় হয়েছে প্রায় ৩৮ কোটি ৬০ লাখ টাকা। এসব রপ্তানির ৯৫ শতাংশই ছিল গরুর বুলস্টিক।

কোথায় যায় এই পণ্য?

প্রধানত যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় রপ্তানি হচ্ছে এই অপ্রচলিত পণ্য। ২০২৩–২৪ অর্থবছরে মে মাসে ৫টি প্রতিষ্ঠান ১৪ হাজার ৭৫২ কেজি বুলস্টিক রপ্তানি করেছে, যার বাজারমূল্য ছিল ৩ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে ৬০ শতাংশ গিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে এবং ৪০ শতাংশ কানাডায়। মান ও ধরন অনুযায়ী প্রতি কেজি বুলস্টিকের দাম ১৮ থেকে ৩৫ মার্কিন ডলার পর্যন্ত হয়ে থাকে।

কীভাবে তৈরি হয় বুলস্টিক?

বুলস্টিক রপ্তানির জন্য একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়। গরু জবাইয়ের পর লিঙ্গ সংগ্রহ করে তা ফ্রিজারে রাখা হয়। এরপর ভালোভাবে ধুয়ে চামড়া ও চর্বি ছাড়িয়ে মূত্রনালি আলাদা করা হয়। পরে তা আবার পরিষ্কার করে বাণিজ্যিক ওভেনে ৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ৬০ মিনিট ধরে শুকানো হয়। সূর্যরশ্মিতে শুকানো হলেও বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণের ঝুঁকি থাকে, তাই ওভেনে শুকানোর প্রক্রিয়াই বেশি গ্রহণযোগ্য।

শুকানোর পর প্রতিটি বুলস্টিক নির্দিষ্ট মাপে (৬ ও ১২ ইঞ্চি) কেটে ভ্যাকুয়াম প্যাকিং করা হয়। এরপর প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসনদ ও রপ্তানির ছাড়পত্র নিয়ে তা বিদেশে পাঠানো হয়। শুকনো অবস্থায় পণ্যের আর্দ্রতা ৫ থেকে ১০ শতাংশের মধ্যে থাকা বাধ্যতামূলক।

দেশে কেমন চলছে সংগ্রহ?

বাংলাদেশে প্রতি বছর এক কোটিরও বেশি গরু ও মহিষ জবাই করা হয়। দেশের প্রায় সব জেলা থেকেই বুলস্টিক সংগ্রহ করেন মধ্যস্বত্বভোগীরা। সাভারের হেমায়েতপুরের হাফিজুর রহমান গত ছয় বছর ধরে গরুর চামড়া, ভুঁড়ি ও বুলস্টিকের ব্যবসা করছেন। তিনি প্রতি মাসে বরিশাল, কুষ্টিয়া ও আশপাশের ১৫টিরও বেশি জেলা থেকে ১৫ থেকে ১৭ হাজার বুলস্টিক সংগ্রহ করেন এবং এ ব্যবসা থেকে আয় করেন মাসে ১ লাখ থেকে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত।

সিরাজগঞ্জের একরামুল হক এই ব্যবসায় যুক্ত আছেন সাত বছর ধরে। তিনি জানান, প্রতি মাসে ৪০ হাজার বুলস্টিক সংগ্রহ করে ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা আয় করেন। উত্তরের ২০টি জেলা থেকে পণ্য সংগ্রহ করেন তিনি। বর্তমানে সিরাজগঞ্জেই এ ধরনের ব্যবসায় জড়িত আছেন ১৮ থেকে ২০ জন।

দাম ও বাজারদর

সাভারে বুলস্টিক কেজি দরে বিক্রি হয়। ২৫০ গ্রাম ওজনের কম বুলস্টিক প্রতি কেজি ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা এবং ৩০০ গ্রাম বা তার বেশি ওজন হলে তা বিক্রি হয় ৩৮০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত। তবে মান ও আকৃতি অনুযায়ী দামে কিছুটা তারতম্য হয়ে থাকে।

রপ্তানির চ্যালেঞ্জ

এই খাতে ব্যবসা সম্প্রসারণে কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। আগে রপ্তানিতে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ প্রণোদনা থাকলেও এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৬ শতাংশে। এতে অনেকেই আগ্রহ হারাচ্ছেন। এছাড়া ব্যাংকঋণ পাওয়াও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে, কারণ এটি এখনো অপ্রচলিত পণ্যের মধ্যে পড়ে।

ফ্রন্টিয়ার পেট ফুডস নামে একটি প্রতিষ্ঠান ২০২২ সাল থেকে বুলস্টিক রপ্তানি করছে। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক আবিদ আজাদ বলেন, মাসে গড়ে দেড় টন রপ্তানি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায়। একটি সমিতি গঠনের মাধ্যমে এই ব্যবসা আরও সংগঠিত করতে চান তারা।

সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া ও প্রযুক্তির অভাব

যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করতে গেলে পণ্যে গামা রেডিয়েশন প্রয়োগ বাধ্যতামূলক। বর্তমানে বাংলাদেশে এই সেবা দেয় সাভারের পারমাণবিক শক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠান। তবে এক টন পণ্য রেডিয়েশনের জন্য পাঠালে তা করতে সময় লাগে এক থেকে দেড় মাস। এতে করে সময় ও খরচ—দুটোই বাড়ে।

এম এম রাইয়ান ট্রেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সিরাজুল হাসান বলেন, সময় কমাতে আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তা প্রয়োজন। পাশাপাশি বিএসই সার্টিফিকেট থাকলে ইউরোপের বাজারে প্রবেশ সহজ হবে। ইউরোপে রপ্তানি শুরু হলে কয়েক বছরের মধ্যেই রপ্তানির পরিমাণ দ্বিগুণ হবে।

সরকারি উদ্যোগের প্রয়োজন

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের উৎপাদন শাখার পরিচালক এ বি এম খালেদুজ্জামান বলেন, কয়েক বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নে বিএসই ও আইএসও সার্টিফিকেট পেতে ‘গুড ল্যাবরেটরি প্র্যাকটিস প্রোগ্রাম (GLPP)’ চালু হয়েছিল। কিন্তু অর্থায়ন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তা থেমে গেছে। এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো অধিদপ্তরের সক্ষমতা বাড়ানো ও প্রশিক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় বাজেট নিশ্চিত করা।


সারাংশ:
বুলস্টিক এক সময় ফেলনা মনে হলেও, আজ তা কোটি টাকার রপ্তানি পণ্য। সরকারের সহযোগিতা ও প্রণোদনা বাড়ানো হলে এই খাত হয়ে উঠতে পারে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম বড় উৎস। বাংলাদেশের গরু-মহিষ জবাইয়ের পর অবশিষ্টাংশ এখন আর ফেলনা নয়—তা হয়ে উঠেছে মূল্যবান সম্পদ।

No comments

Powered by Blogger.