সংস্কার ইস্যুতে দলগুলোর ঐকমত্য অনিশ্চিত
সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তিন দফা আলোচনা হলেও কোনো ঐকমত্য গড়ে তুলতে পারেনি জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। একইভাবে, বেশির ভাগ মৌলিক সংস্কার প্রস্তাব নিয়েও দলগুলোর মধ্যে মতৈক্য হয়নি।
গতকাল রোববার এক বৈঠকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ বলেন, “আমরা স্বপ্ন দেখেছিলাম, ১৬ জুলাই আবু সাঈদের শাহাদাতবার্ষিকীতে সবাই মিলে ‘জুলাই সনদে’ স্বাক্ষর করব। কিন্তু এখন বাস্তবতা বলছে, সেটা কতটা সম্ভব হবে, তা নির্ভর করছে রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর। এ বিষয়ে এখন খানিকটা শঙ্কা তৈরি হয়েছে।”
সংস্কার ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় পর্বের বিষয়ভিত্তিক আলোচনা চালাচ্ছে ঐকমত্য কমিশন। ২০টি মৌলিক সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা থাকলেও সাত দিনের আলোচনায় এখন পর্যন্ত ৯টি বিষয়ে আলোচনা হয়েছে, যার মধ্যে মাত্র দুটি বিষয়ে পূর্ণ ঐকমত্য এবং কিছু বিষয়ে আংশিক ঐকমত্য অর্জিত হয়েছে। তবে কোনো প্রস্তাব আলোচনার বাইরে যায়নি।
২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে অন্তর্বর্তী সরকার ছয়টি কমিশন গঠন করে—সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন, জনপ্রশাসন এবং পুলিশ সংস্কার কমিশন। এসব কমিশন ফেব্রুয়ারিতে তাদের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন জমা দেয়। পরে এ ছয় কমিশনের প্রধানদের নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে গঠিত হয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। কমিশন ১৬৬টি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার সুপারিশ দলগুলোর কাছে পাঠিয়ে তাদের মতামত নেয়। এরপর ২০ মার্চ থেকে ১৯ মে পর্যন্ত দলগুলোর সঙ্গে পৃথক আলোচনা হয়। ২ জুন দ্বিতীয় পর্বের যৌথ আলোচনা শুরু হয়।
দলগুলোর দ্বিমত ও শঙ্কা
গতকালের আলোচনায় ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন, “সংস্কারের মৌলিক প্রস্তাবগুলোর ক্ষেত্রে বিএনপি ও আরও কয়েকটি দল দ্বিমত পোষণ করছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলোচনা করেও ঐ বিষয়ের নিষ্পত্তি হচ্ছে না, যা আশঙ্কার জায়গা তৈরি করছে।”
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, “নিয়োগ কমিটি নিয়ে আগেও আলোচনা হয়েছে, কিন্তু সবাইকে একমত করানো প্রায় অসম্ভব। বিএনপি প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে।”
এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন জানান, “১১টা থেকে তিন ঘণ্টা আলোচনা শেষে বিএনপির সালাহউদ্দিন আহমদের কাছে গিয়ে আলোচনা আটকে যায়। বিকেলে আবার তিনটা থেকে প্রায় পাঁচটা পর্যন্ত আলোচনা করেও একই ফল হয়েছে।” তিনি প্রস্তাব দেন, “আগে বিএনপিকে প্রস্তাব দিন, তারা যেগুলোতে একমত তা আলোচনা টেবিলে আনুন।”
এর আগে গণ–অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক বলেছিলেন, “কিছু দল একেবারেই নিজেদের অবস্থানে অনড়। এভাবে চললে কিয়ামত পর্যন্ত কোনো ঐক্য হবে না।”
বিএনপির পাল্টা অবস্থান
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, “আমরা অনেক বিষয়ে একমত হয়েছি। কিন্তু যদি আমাদের ১০০ শতাংশ প্রস্তাবে একমত হতে বাধ্য করা হয়, তাহলে আলোচনার মানে কী?”
তিনি আরও বলেন, “যেসব বিষয়ে একমত হওয়া সম্ভব, সেগুলো নিয়েই জাতীয় সনদ হবে। আমাদের যদি সব প্রস্তাবেই একমত হতে বলা হয়, সেটা যুক্তিসঙ্গত নয়।”
নিয়োগ কমিটি ও দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ নিয়ে ভিন্নমত
গতকাল আলোচনা হয় সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ কমিটি ও সংসদের উচ্চকক্ষ নিয়ে। ঐকমত্য কমিশন নিয়োগ কমিটি নিয়ে একটি প্রস্তাব দেয়, যা অধিকাংশ দল নীতিগতভাবে সমর্থন করলেও বিএনপি ও কিছু দল বিরোধিতা করে।
সংসদকে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট করার প্রস্তাবে অধিকাংশ দল একমত হলেও উচ্চকক্ষ গঠনের পদ্ধতি ও ক্ষমতা নিয়ে ভিন্নমত রয়ে গেছে। সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী, দলগুলো জাতীয় নির্বাচনে যত ভোট পাবে, সেই অনুপাতে উচ্চকক্ষে আসন বরাদ্দ হবে। জামায়াত, এনসিপিসহ অনেক দল এতে একমত হলেও, বিএনপি ও কিছু দল এতে আপত্তি জানায়। তারা চায়, উচ্চকক্ষে আসন বরাদ্দ হোক নিম্নকক্ষে প্রাপ্ত আসনের ভিত্তিতে।
সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, “নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতা হ্রাস হয় এমন কোনো বিধান সংবিধানে রাখা উচিত নয়।” তিনি এ বিষয়ে আগেও বক্তব্য রেখেছেন। তিনি প্রশ্ন তোলেন, “একই বিষয়ে বারবার আলোচনা করার মানে কী, যদি আমরা ঐকমত্য তৈরির প্রক্রিয়া ঠিক না করি?”
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, “নিম্নকক্ষের আসনের অনুপাতে উচ্চকক্ষ গঠিত হলে সেটি নিম্নকক্ষের প্রতিরূপ হবে। আমরা এখন নিম্নকক্ষে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি চাই না, তবে উচ্চকক্ষে সেটি দরকার।”
এনসিপির আখতার হোসেন বলেন, “আমরা এমন বাংলাদেশ চেয়েছিলাম, যেখানে ক্ষমতার ভারসাম্য থাকবে। যদি প্রধানমন্ত্রীর হাতে সব ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়, তাহলে এই আলোচনা, এই প্রাণ বিসর্জনের কোনো অর্থ থাকে না।”
ইসলামী আন্দোলনের প্রেসিডিয়াম সদস্য আশরাফ আলী আকন বলেন, “আমরা চাই নিম্নকক্ষেও সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন হোক। অনেক দল একই দাবি তুলেছে। কিন্তু ঐকমত্য আলোচনায় বিষয়টি এলে ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়।”
কমিশনের পর্যবেক্ষণ
আলোচনা শেষে আলী রীয়াজ সাংবাদিকদের বলেন, “নিয়োগ কমিটির প্রস্তাব অধিকাংশ দল সমর্থন করেছে। কয়েকটি দল এখনো একমত নয়, তাদের জন্য প্রস্তাব সংশোধনের কথা বিবেচনা করছি। আশা করছি, পরবর্তী আলোচনায় বিষয়টি নিষ্পত্তি হবে।”
তিনি আরও জানান, অধিকাংশ দল সংসদে দ্বিতীয় কক্ষ চায়। উচ্চকক্ষ গঠনে কেউ সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির পক্ষে, কেউ বিপক্ষে। জুলাইয়ের মধ্যে আলোচনার কাজ শেষ করে ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণা করা হবে বলে জানান তিনি।
২ জুলাই পরবর্তী বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। গতকালের আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন কমিশনের সদস্য বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, বদিউল আলম মজুমদার, মো. আইয়ুব মিয়া। সঞ্চালনার দায়িত্বে ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার।
No comments