Header Ads

তারেক-ইউনূসের আলোচনা: সংকটের অবসান না নতুন জটিলতা?

 
  

তারেক-ইউনূসের আলোচনা: সংকটের অবসান না নতুন জটিলতা?

সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা নির্দলীয় অন্তর্বর্তী সরকারের স্বাভাবিক কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটাচ্ছিল। এ অবস্থায় লন্ডনে নির্বাসিত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের বৈঠক স্বাভাবিকভাবেই সবার কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। বৈঠকের আগে থেকেই দুই পক্ষের বক্তব্যে বোঝা যাচ্ছিল—এই আলোচনা উভয় পক্ষের জন্যই জরুরি ছিল। বৈঠকের পর উভয়ের সন্তুষ্টি প্রকাশ—একটি স্বস্তিদায়ক বার্তা বটে।

তবে এখন প্রশ্ন উঠছে—এই স্বস্তি কি দীর্ঘস্থায়ী হবে? কারণ, সংকটের গভীরতা এবং দুই পক্ষের মধ্যকার দূরত্ব কতটা ছিল, তা নির্ধারণ করবে এই সমঝোতার স্থায়িত্ব। বিএনপির মধ্যে নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা বা সংশয়ের যে ধারণা তৈরি হয়েছিল, সেটি দলীয় শীর্ষ নেতৃত্বের চেয়ে মাঠের কর্মীদের মধ্যে বেশি প্রকট ছিল। পাশাপাশি ষড়যন্ত্রতত্ত্ব প্রচারকারীদের কথাবার্তাও ওই সংশয় বাড়িয়েছিল।

অন্যদিকে, অন্তর্বর্তী সরকারের সমর্থকদের একাংশ সংস্কার ছাড়া নির্বাচনে না যাওয়ার দাবি ও সরকারকে ৫-১০ বছরের সময় দেওয়ার প্রচারে অনেকের মনেই সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়।

রমজান যেহেতু ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি শুরু, তাই নির্বাচন তার আগে হলে অন্তর্বর্তী সরকারের আপত্তি নেই—এমন বার্তা ইতিপূর্বেও এসেছে এবং এবারও প্রধান উপদেষ্টা তা স্পষ্ট করেছেন। আলোচনার সূত্রে জানা গেছে, প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি থাকলে রমজানের আগের সপ্তাহেই নির্বাচন সম্ভব। তবে এর জন্য ন্যূনতম কাঙ্ক্ষিত সংস্কার ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকাজে কিছু অগ্রগতি থাকতে হবে। অধ্যাপক ইউনূসের ন্যূনতম লক্ষ্য হচ্ছে, একটি স্মারকস্বরূপ অগ্রগতি রেখে দেশের দায়িত্ব নির্বাচিত সরকারের হাতে তুলে দেওয়া।

তারেক রহমানও নির্বাচনের আগে সীমিত সময়ের মধ্যে ন্যূনতম সংস্কার ও বিচার কার্যক্রমের প্রয়োজনীয়তা মেনে নিয়েছেন। তিনি কোনো অনমনীয় সময়সীমা আরোপ করেননি। নির্বাচনের সময় নিয়ে এই নমনীয়তা উভয় পক্ষের মধ্যে যে দূরত্ব ছিল, তা অনেকটা ঘুচিয়ে দিয়েছে। এরপর দুজন একান্তে প্রায় ১ ঘণ্টা ২০ মিনিট আলোচনা করেন—যা বৈঠকের মোট সময়ের ৯০ শতাংশ।

এ দীর্ঘ একান্ত আলোচনা কী বিষয়ে হয়েছে, তা নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই নানা জল্পনা-কল্পনা রয়েছে। তবে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব জানিয়েছেন, দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে তারেক রহমান তাঁর নিজস্ব ভাবনা ও পরিকল্পনা ইউনূসকে তুলে ধরেছেন এবং ইউনূস তাতে মুগ্ধ হয়েছেন বলেই জানা গেছে। এই চিন্তাধারাগুলো ভবিষ্যতে বিশদভাবে জানতে আগ্রহ থাকলেও আপাতত তা সংবরণ করতে হচ্ছে।

বিএনপির অভ্যন্তরে যেসব সন্দেহ ও দ্বিধা প্রকাশ পেয়েছিল, অনেক ক্ষেত্রেই তা শালীনতার সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। শীর্ষ নেতৃত্ব কিছু ক্ষেত্রে কঠোর অবস্থান নিলেও তা যথেষ্ট ছিল কি না, তা ভেবে দেখা জরুরি। বড় দলে শৃঙ্খলা রক্ষা সব সময়ই কঠিন। তবে স্বৈরাচারমুক্ত একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে বিএনপির মতো দলের উচিত এ চ্যালেঞ্জ সফলভাবে মোকাবিলা করা।

অন্যদিকে, বৈঠকের প্রেক্ষিতে বিএনপির সঙ্গে দূরত্ব ঘোচানোর পাশাপাশি অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যেন দূরত্ব না বাড়ে, সেটাও এখন অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বিএনপির প্রতিদ্বন্দ্বী বা ঈর্ষাপরায়ণ কিছু রাজনৈতিক দল এই বৈঠককে ইতিবাচকভাবে নাও নিতে পারে। তারা প্রশ্ন তুলতে পারে—নির্বাচনের সময়সীমায় নমনীয়তা দেখিয়ে বড় দলের প্রতি বিশেষ সুবিধা দেওয়া হলো কি না। বিশেষ করে নতুন গঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও তাদের সমর্থকরা ইতোমধ্যেই বিএনপির বিরুদ্ধে সংস্কার ও বিচার নিয়ে গুরুত্বহীনতার অভিযোগ তুলেছে। এই সমালোচনা পুরোপুরি ভিত্তিহীন না হলেও, তা যেন রাজনৈতিক ঐক্যে ফাটল না তোলে, সে বিষয়েও সবার সচেতন থাকা জরুরি।

লন্ডনের এই আলোচিত বৈঠকের আগে ইউনূস অংশ নিয়েছিলেন ১১ জুন রয়্যাল ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স বা চ্যাথাম হাউস আয়োজিত একটি আলোচনায়। সেখানে তিনি তার অবস্থান পরিষ্কার করে জানান, তিনি ভবিষ্যতে কোনো রাজনৈতিক ভূমিকা নিতে চান না, এমনকি গণভোটের ধারণাও প্রত্যাখ্যান করেন। ইউনূসের এই বক্তব্য তাঁর বিরুদ্ধে থাকা রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার অভিযোগ অনেকটাই খণ্ডন করে।

চ্যাথাম হাউসের আলোচনায় তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা নির্বাচনে অংশ নিতে আগ্রহী নন। তাঁদের লক্ষ্য একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন করে নির্বাচিত সরকারের কাছে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর। ছাত্র আন্দোলন থেকে আসা দুই উপদেষ্টার নিয়ে নির্বাচনী রাজনীতিতে জড়ানোর আশঙ্কাও তিনি নাকচ করেছেন।

তারেক রহমান বৈঠকের সময় ইউনূসকে একটি কলম ও দুটি বই উপহার দেন। বই দুটি হলো: Nature Matters এবং গ্রেটা থুনবার্গের লেখা No One Is Too Small to Make a Difference। পরিবেশ ও ব্যক্তিগত উদ্যোগের শক্তিকে ইউনূস গুরুত্ব দেন—এ বিষয়গুলো উপহারের মাধ্যমে স্পষ্ট হয়েছে। তাই এই উপহারও ছিল যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ।

সব মিলিয়ে, লন্ডনের এই বৈঠক একটি ইতিবাচক অগ্রগতি। নির্বাচনের রোডম্যাপ নিয়ে বিরোধ কমেছে এবং একটা বাস্তবমুখী সমঝোতার পথ তৈরি হয়েছে। তবে এটি কতটা টেকসই হবে, তা নির্ভর করবে পরবর্তী কার্যক্রম, আন্তরিকতা এবং অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তির প্রতিক্রিয়ার ওপর। শান্তিপূর্ণ এবং গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনের পথে এই বৈঠক যে একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

No comments

Powered by Blogger.