বৈশাখ নিয়ে রাজনীতি?
নিশ্চিতভাবেই বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি বেশ জটিল এবং নানা প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। শেখ হাসিনা দীর্ঘ ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকার সময় অনেক সিদ্ধান্তই ভারতের স্বার্থকে গুরুত্ব দিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ আছে। তবে, দেশের ৯২% মুসলমানের অনুভূতিকে বিবেচনায় রেখে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের জন্য পহেলা বৈশাখ উদযাপন বাধ্যতামূলক করেননি—এটি এক ধরনের সংবেদনশীলতার প্রকাশও বলা যায়।
তবুও, মাদরাসা শিক্ষার্থীদের নিয়ে পহেলা বৈশাখ উদযাপন বাধ্যতামূলক করার মতো প্রস্তাব আসছে কেন—এ নিয়ে মানুষের মনে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে। এর মধ্যে সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়ার পর এবং ‘ডেভিল হান্ট’ নামে একটি অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও অপরাধ দমনের চেষ্টা চললেও, ঠিক কীভাবে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এতটা সংগঠিত হয়ে ঢাকায় অভিযান ও জমায়েত করার সাহস দেখাতে পারছে—তাও বিস্ময় তৈরি করছে।
বাংলাদেশ একটি মুসলিম প্রধান দেশ, যেখানে প্রায় ৯২ শতাংশ মানুষ ইসলাম ধর্ম অনুসরণ করে। এমন প্রেক্ষাপটে বাংলা নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ উদযাপন নিয়ে নানা সময় বিতর্ক দেখা দিয়েছে। অনেকেই প্রশ্ন তোলেন, ইসলামি জীবনদর্শনের সঙ্গে এ উৎসবের কতটা সামঞ্জস্য আছে।
তথ্য অনুযায়ী, বাংলা সনের সূচনা হয় মুঘল সম্রাট আকবরের শাসনামলে। তিনি কৃষি খাজনা আদায় সহজ করতে বাংলা বছর প্রবর্তন করেন, যাতে হিজরি সনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সময় নির্ধারণ করা যায়। এ ক্যালেন্ডারকে বলা হতো তারিখ-ই-ইলাহি। ফলে বাংলা সন ও হিজরি সনের মাঝে এক ধরণের মিল লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাংলা নববর্ষ উদযাপন পেয়েছে নতুন রূপ ও রীতি।
ষাটের দশকের মাঝামাঝি ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’ নামের এক আয়োজনের মধ্য দিয়ে নববর্ষ উদযাপনের একটি সাংস্কৃতিক মাত্রা যুক্ত হয়। পরে ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার সরকারের আমলে এই আনন্দ শোভাযাত্রার নাম পরিবর্তন করে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ করা হয়, যা বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের প্রধান আয়োজন।
সম্প্রতি একটি নির্দেশনায় দেখা যায়, মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তর দেশের সব মাদরাসায় বাংলা নববর্ষ উদযাপন বাধ্যতামূলক করেছে। এই সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে— ইসলামি শিক্ষাকেন্দ্রগুলোর জন্য এমন নির্দেশনা কতটা যৌক্তিক? আদৌ কি মাদরাসার শিক্ষার্থীদের এই ধরনের সাংস্কৃতিক উৎসবে অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত?
বলা হয়েছে, চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো ও অন্যান্য আদিবাসী গোষ্ঠীর নববর্ষ উপলক্ষে দুটি দিনব্যাপী উৎসব উদযাপন করতে হবে। এতে অনেকেই মনে করছেন, মাদরাসা শিক্ষার্থীদের উপর একটি নির্দিষ্ট সাংস্কৃতিক ধারা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে।
এছাড়া একটি ভিন্ন প্রসঙ্গে দেখা গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় আনন্দ শোভাযাত্রার প্রস্তুতিকালে আগুনে পুড়ে যায় ‘ফ্যাসিস্টের প্রতিকৃতি’ ও ‘শান্তির পায়রা’ মোটিফ। এত নিরাপত্তার মধ্যেও এমন ঘটনা ঘটায় জনমনে প্রশ্ন উঠেছে: নিরাপত্তা বাহিনীর তৎপরতা থাকা সত্ত্বেও অগ্নিসংযোগ কীভাবে সম্ভব হলো? কেউ কেউ বলছেন, ঘটনা নিছক বিচ্ছিন্ন নয়— বরং এতে ভেতরের কোনো দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে।
এর সঙ্গে আবার রাজনৈতিক পরিস্থিতি জড়িত হয়েছে। সম্প্রতি গোয়েন্দা তথ্য বলছে, নিষিদ্ধ ঘোষিত দল বা রাজনৈতিক দলের সদস্যরা গোপনে রাজধানীমুখী হচ্ছেন। চট্টগ্রাম ডিএসবি থেকে থানা পর্যায়ে পাঠানো চিঠিতে সতর্কতামূলক নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, যাতে রাজনৈতিক অস্থিরতা প্রতিহত করা যায়।
সরকার দাবি করেছে— আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় চলছে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’। এতে চুনোপুঁটি কিছু ব্যক্তি গ্রেফতার হলেও বড় নেতারা এখনও প্রকাশ্যে সক্রিয় রয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। অনেকেই মনে করছেন, অভিযানের নামে ‘আইওয়াশ’ চলছে।
অন্যদিকে, সরকার দাবি করে আসছে যে এই সাংস্কৃতিক আয়োজনগুলো জাতীয় ঐক্য, সম্প্রীতি ও বহুত্ববাদী চেতনা প্রকাশের মাধ্যম। কিন্তু এ প্রসঙ্গে অনেকেই প্রশ্ন করছেন— অর্থনৈতিক মন্দা, জিডিপির নিম্নমুখী প্রবৃদ্ধি, ব্যাংকিং খাতের অস্থিরতা, ঈদ উৎসবের পর ছুটির আমেজ— সব মিলিয়ে এই সময়ে মহাসমারোহে পহেলা বৈশাখ উদযাপন কতটা যৌক্তিক?
সার্বিক পরিস্থিতি বিচার করে বলা যায়, পহেলা বৈশাখ উদযাপন এখন কেবল সাংস্কৃতিক উৎসব নয়, বরং এটি ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিকভাবে একটি বিতর্কের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর এমন সিদ্ধান্তের পেছনে প্রকৃত উদ্দেশ্য কী— সেই প্রশ্নও এখন আরও বেশি করে সামনে আসছে।
No comments