Header Ads

গাজায় কীভাবে নির্বিচারে হত্যা চলে, জানালেন ইসরায়েলি সেনা

            

গাজায় কীভাবে নির্বিচারে হত্যা চলে, জানালেন ইসরায়েলি সেনা


   

গাজা উপত্যকায় দায়িত্ব পালন করা এক ইসরায়েলি রিজার্ভ সেনা স্কাই নিউজকে দেওয়া এক বিরল সাক্ষাৎকারে চাঞ্চল্যকর দাবি করেছেন। তিনি জানান, যুদ্ধ চলাকালে তার ইউনিটকে এমন আদেশ দেওয়া হয়েছিল—নির্দিষ্ট একটি সীমারেখা অতিক্রম করলেই গুলি চালাতে হবে, সে ব্যক্তি বেসামরিক হোক বা না হোক।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই সেনা বলেন, ‘আমাদের একটি নির্দিষ্ট এলাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল। আদেশ ছিল—সেই এলাকায় কেউ প্রবেশ করলেই তাকে হত্যা করতে হবে। সে কে, তার বয়স কত, কী পোশাক পরেছে, বা তার হাতে অস্ত্র আছে কি না—তা বিবেচ্য নয়।’

তিনি জানান, গাজায় তিনবার দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতায় তিনি অনেক সাধারণ মানুষকে গুলিতে নিহত হতে দেখেছেন। এসব হত্যাকাণ্ড ছিল ‘ইচ্ছাকৃত ও নির্বিচার’। কমান্ডার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গেই নীতিরও পরিবর্তন হতো।

ওই সেনা ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর (IDF) ২৫২তম ডিভিশনের সদস্য ছিলেন। তিনি গাজা যুদ্ধে শুরুর দিকে দু’বার মোতায়েন হয়েছিলেন নেতসারিম করিডোরে—যা গাজার মাঝখান দিয়ে সমুদ্র থেকে ইসরায়েলি সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত। এর উদ্দেশ্য ছিল গাজাকে উত্তর ও দক্ষিণে বিভক্ত করে কৌশলগত সুবিধা নেওয়া।

তিনি বলেন, তার ইউনিট একটি ফিলিস্তিনি পরিবারের ফেলে যাওয়া বাড়িতে ঘাঁটি গড়ে তোলে এবং চারপাশে একটি ‘অদৃশ্য সীমারেখা’ নির্ধারণ করে, যেখানে গাজাবাসীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল।

‘আমাদের বলা হতো, গাজার সব মানুষ জানে এই সীমারেখা পেরোনো মানে মৃত্যু। কিন্তু আমার প্রশ্ন, তারা কীভাবে জানবে? কে তাদের বলেছে এই নিয়মের কথা?’—বলছিলেন ওই সেনা।

তিনি আরও বলেন, ‘একবার দেখি—এক কিশোর সাইকেল চালিয়ে সীমা অতিক্রম করল, সাথে সাথেই গুলি করা হলো। আবার এক বৃদ্ধ লোহা কুড়াতে গিয়ে প্রাণ হারালেন।’

ওই সেনা দাবি করেন, অনেক ইসরায়েলি সেনার মধ্যে বিশ্বাস জন্মেছে—‘গাজার কেউই নির্দোষ নয়’। ফলে নিরস্ত্র বেসামরিক লোকজনকেও সন্দেহের চোখে দেখে গুলি করা হয়।

‘কমান্ডাররা বলেন, কেউ যদি আসে, তার মানে সে জানে এখানে না আসার কথা। তবুও সে এসেছে, মানে সে সন্ত্রাসী। অথচ আমি জানি, তারা আসলে দরিদ্র, অসহায় মানুষ। তাদের কোথাও যাওয়ার উপায় নেই,’— বলেন তিনি।

একবার এক ব্যক্তি সীমারেখা অতিক্রম করলে তাকে গুলি করে মারা হয়। কিছুক্ষণ পর তার মরদেহ নিতে আসা একজনকে প্রথমে আটক করার নির্দেশ আসে। কিন্তু ঘণ্টা দুয়েক পরেই নতুন আদেশ আসে—যদি কেউ আসে, তাকেও গুলি করতে হবে।

‘প্রতিটি কমান্ডার নিজের মতো সিদ্ধান্ত নেয়। এটা যেন একেকটা "ওয়াইল্ড ওয়েস্ট"। যুদ্ধাপরাধ করলেও কারো জবাবদিহি করতে হয় না,’—যোগ করেন তিনি।

স্কাই নিউজ জানায়, ইসরায়েলে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে সমালোচনা অত্যন্ত বিরল। কারণ, সেনাবাহিনী দেশটির জাতীয় গর্বের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়। সেখানে সেনাবাহিনীর সমালোচনাকে অনেকেই দেশদ্রোহিতা হিসেবে দেখেন।

তবুও ওই সেনা সাহস করে মুখ খুলেছেন। তার ভাষায়, ‘আমি মনে করি, আমি একটা ভুলের অংশ ছিলাম। এখন অন্তত সত্যি বলে কিছুটা দায় হালকা করতে চাই।’

তিনি আরও বলেন, ‘এই যুদ্ধ আমাদের সবার জন্য বিপজ্জনক। এটা থামা উচিত। কিন্তু ইসরায়েলি সমাজ আত্মসমালোচনার অভ্যস্ত নয়। তারা ভাবে যুদ্ধ দরকার, জিম্মিদের উদ্ধার করতে হবে। কিন্তু এই যুদ্ধ আসলে কী ফল বয়ে আনছে, তা অনেকেই জানে না।’

‘আমি আশা করি, আমার কথাগুলো হয়তো কিছু মানুষের চোখ খুলে দেবে।’

এ বিষয়ে আইডিএফ-এর প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে সেনাবাহিনী স্কাই নিউজকে একটি বিবৃতি দেয়। তাতে বলা হয়, ‘আইডিএফ আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলে এবং বেসামরিক হতাহতের ঝুঁকি কমাতে সব ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করে।’

তারা আরও দাবি করে, তারা কেবল সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালায় এবং সাধারণ নাগরিকদের লক্ষ্য করে না। গাজায় ঘটে যাওয়া ব্যতিক্রমী ঘটনাগুলোর তদন্তের জন্য নির্ধারিত কর্তৃপক্ষ রয়েছে এবং বেসামরিকদের নিরাপদে সরিয়ে নিতে নিয়মিত সতর্কবার্তা দেওয়া হয়।

তবে, বাস্তবে সেই বিবৃতির সঙ্গে বাস্তবতার কতটা মিল—সেই প্রশ্ন থেকেই যায়। আর এক সাহসী সেনার এই স্বীকারোক্তি হয়তো সেই প্রশ্নের জবাব খোঁজার পথে একটি ছোট্ট পদক্ষেপ মাত্র।

No comments

Powered by Blogger.