Header Ads

সঞ্চয়পত্র থেকে মুখ সরিয়ে নিচ্ছেন কেন বিনিয়োগকারীরা ?

        

সঞ্চয়পত্র থেকে মুখ সরিয়ে নিচ্ছেন কেন বিনিয়োগকারীরা ?





আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্ত পূরণ করতে গিয়ে সরকার সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে। কমানো হয়েছে সঞ্চয়পত্রের সুদহারও। এতে মূল্যস্ফীতির চাপে মানুষ সঞ্চয়পত্র ভাঙাতে বাধ্য হচ্ছে। বিশেষ করে নিম্ন-মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত, পেনশনার এবং ঝুঁকিপূর্ণ বয়সী নাগরিকদের কাছে সঞ্চয়পত্র এখন আর আগের মতো আকর্ষণীয় থাকছে না।

জীবনযাত্রার ব্যয় সামাল দিতে সঞ্চয়পত্রের সুদ অনেকের জন্য নির্ভরযোগ্য উৎস ছিল। কিন্তু সুদহার কমানোয় সাধারণ মানুষ সেই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। গত তিন অর্থবছরে সরকার সঞ্চয়পত্র বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা ৩৫ হাজার কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ১২ হাজার ৫০০ কোটি টাকায় নামিয়ে এনেছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকার চলতি অর্থবছরে ব্যয় না বাড়িয়ে সংকোচনমূলক বাজেট দিয়েছে। একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকও সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অনুসরণ করছে। এই বাস্তবতায় সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমানো এক ধরনের দ্বন্দ্ব তৈরি করছে।

সঞ্চয়পত্রে সুদ কমে যাওয়ায় মানুষ এখন উচ্চ সুদ দিচ্ছে এমন ব্যাংকগুলোতেই টাকা রাখতে আগ্রহী হচ্ছে। এতে করে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ কমবে, ফলে বাজেট বাস্তবায়নে সরকার সে উৎস থেকে পর্যাপ্ত অর্থ সংগ্রহ করতে পারবে না। এতে ব্যাংক নির্ভরতা বাড়বে এবং ব্যাংক থেকে বেশি ঋণ নেওয়া হলে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ কমবে। যার বিরূপ প্রভাব পড়বে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে।

সাবেক সিনিয়র অর্থসচিব মাহবুব আহমেদ জানিয়েছেন, সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমলে মধ্যবিত্তরা সমস্যায় পড়বে, কারণ অনেকেই এর মুনাফা দিয়ে সংসার চালান। তার মতে, ব্যাংক থেকে ঋণ না নিয়ে সঞ্চয়পত্র থেকেই সরকারের ঋণ নেওয়া উচিত।

অর্থনীতিবিদ এম কে মুজেরী বলেন, আইএমএফ-এর শর্ত পূরণের বাধ্যবাধকতায় সরকারকে অনেক সময় অপ্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে। সঞ্চয়পত্রের সুদ কমে যাওয়ায় বয়স্ক, নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আগে ঘনঘন সুদহার পরিবর্তন হলেও এখন তা সম্ভব হচ্ছে না আইএমএফ-এর শর্তের কারণে। মূল্যস্ফীতির চাপে অনেকেই এখন সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছেন। পাশাপাশি ব্যাংকগুলো উচ্চ সুদ দেওয়ায় সঞ্চয়পত্রে আগ্রহ কমে যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, আগে মানুষ প্রাইজবন্ডেও বিনিয়োগ করত, এখন তাতেও আগ্রহ নেই।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, সঞ্চয়পত্রে বেশি সুদ দেওয়ায় আর্থিক খাত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, বিশেষ করে বন্ড মার্কেট। কারণ, সঞ্চয়পত্রে সুদ বেশি থাকলে বেসরকারি কোম্পানিগুলো বন্ড ইস্যুতে অনাগ্রহী হয়ে পড়ে। ফলে বন্ড মার্কেট উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। তবে সরকারের উচিত সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় থাকা মানুষদের জন্য বিকল্প সহায়তা যেমন—পেনশন ভাতা বাড়ানো।

উল্লেখ্য, আইএমএফ-এর ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ প্যাকেজের গুরুত্বপূর্ণ একটি শর্ত হলো—সরকার যেন সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমায় এবং ঘাটতি বাজেট পূরণে অভ্যন্তরীণ ঋণের মাত্র এক-চতুর্থাংশ সঞ্চয়পত্র থেকে নেয়। এ ছাড়া সুদহারও বাজারভিত্তিক করতে বলা হয়েছে। অর্থাৎ সঞ্চয়পত্রের সুদ নির্ধারণ করা হবে ছয় মাসের গড় ট্রেজারি বিলের হারের ওপর ভিত্তি করে। যদি ট্রেজারি বিলের সুদ কমে, সঞ্চয়পত্রের সুদও কমবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত ছয় মাসে ট্রেজারি বিলের সুদ কমে যাওয়ায় সেই অনুযায়ী সঞ্চয়পত্রের সুদও কমানো হয়েছে। বর্তমানে সাড়ে ৭ লাখ টাকার নিচে সঞ্চয়পত্রে সুদহার ১২.৫৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১১.৮২ শতাংশ এবং সাড়ে ৭ লাখ টাকার ওপরে ১২.৩৭ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১১.৭৭ শতাংশ করা হয়েছে। মধ্যমেয়াদে সঞ্চয়পত্রের সুদহার ৬ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা রয়েছে।

অর্থ বিভাগ সূত্রে আরও জানা যায়, আইএমএফ প্রথম কিস্তির অর্থ দেয় ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে। ওই বছর সঞ্চয়পত্র বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৫ হাজার কোটি টাকা, যা পরের বছর কমে হয় ১৮ হাজার কোটি টাকা। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তা আরও কমে হয় ১৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। সর্বশেষ চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ১২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, সরকার সঞ্চয়পত্রকে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি হিসেবে বিবেচনা করলেও আইএমএফ মনে করে এটি সরকারের দীর্ঘমেয়াদি দায়। কারণ, প্রতি বছর এ খাতে বিপুল পরিমাণ সুদ দিতে হচ্ছে। ফলে বিক্রি ও সুদহার কমানোর সিদ্ধান্তের ফলে একটি বড় জনগোষ্ঠী আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে।

No comments

Powered by Blogger.