Header Ads

রাজসাক্ষী মানে কী, কী সুবিধা মেলে আইনে?

            

রাজসাক্ষী মানে কী, কী সুবিধা মেলে আইনে?




জুলাই মাসে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় প্রথমবারের মতো কোনো মামলায় আনুষ্ঠানিকভাবে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। বৃহস্পতিবার (তারিখ অনির্দিষ্ট) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং তৎকালীন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় চার্জ গঠনের আদেশ দেন।

আসামিদের মধ্যে সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন আদালতে দোষ স্বীকার করে রাজসাক্ষী হওয়ার আবেদন করেন। ট্রাইব্যুনাল তার আবেদন গ্রহণ করে। আইন অনুযায়ী, রাজসাক্ষী সাজা থেকে অব্যাহতি বা লাঘবের সুযোগ পেতে পারেন। তবে তার সাক্ষ্য বিশ্বাসযোগ্য না হলে আদালত সে সুবিধা নাও দিতে পারেন।

রাজসাক্ষী কী?

রাজসাক্ষী হলেন সেই ব্যক্তি, যিনি অপরাধে জড়িত থাকার পর তা আদালতে স্বীকার করেন এবং রাষ্ট্রপক্ষের পক্ষে সাক্ষ্য দিয়ে অপরাধের বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করেন। উদ্দেশ্য থাকে—অন্য অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য দেওয়া এবং নিজের শাস্তি লাঘবের চেষ্টা করা।

ধরা যাক, পাঁচজন মিলে একজনকে হত্যা করেছে। ধরা পড়া একজন অপরাধে নিজের সংশ্লিষ্টতা স্বীকার করে এবং পুরো ঘটনার তথ্য দিয়ে অন্যদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়—তখন সে রাজসাক্ষী হিসেবে গণ্য হয়।

আইনগত প্রেক্ষাপট

বাংলাদেশের প্রচলিত ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় রাজসাক্ষীর বিধান রয়েছে ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৩৭ ও ৩৩৮ ধারায়। এই ধারায় বলা হয়েছে, তদন্ত বা বিচারের যেকোনো পর্যায়ে ম্যাজিস্ট্রেট কোনো ব্যক্তিকে অপরাধের পুরো সত্য প্রকাশ করার শর্তে ক্ষমা দেওয়ার প্রস্তাব দিতে পারেন।

১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইনের ১৩৩ ধারা অনুযায়ী, দুষ্কর্মে অংশগ্রহণকারী কেউ সাক্ষ্য দিলেও তা আইনত গ্রহণযোগ্য।

জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, “ফৌজদারি আইনের বিধান অনুযায়ী, রাজসাক্ষী হলে আদালত তাকে সাজা মওকুফ করতে পারে। তবে সেটা নির্ভর করবে তার দেওয়া সাক্ষ্যের গ্রহণযোগ্যতার ওপর।”

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ব্যতিক্রম

এই বিচার হচ্ছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আওতায়, যেখানে রাজসাক্ষী সংক্রান্ত পৃথক বিধান রয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩-এর ১৫ ধারা অনুসারে, ট্রাইব্যুনাল অপরাধে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত ব্যক্তিকে অপরাধের সত্য প্রকাশের শর্তে ক্ষমা করতে পারে এবং সাক্ষী হিসেবে উপস্থাপন করতে পারে।

এই আইনের অধীনে রাজসাক্ষী হতে যাওয়া চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনই হবেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রথম রাজসাক্ষী।

ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটরদের একজন (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) জানান, মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত মামুনকে হেফাজতে রাখা হবে। তাকে সাক্ষ্যগ্রহণের সময় আদালতে উপস্থাপন করা হবে এবং অন্য আসামিপক্ষ তাকে জেরা করার সুযোগ পাবে।

চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, “রাজসাক্ষী হওয়ায় মামুনকে অব্যাহতি দেওয়া হবে কিনা, তা আদালত নির্ধারণ করবেন। সাক্ষ্য বিশ্বাসযোগ্য হলে তাকে ক্ষমা করার সুযোগ আইনে রয়েছে।”

রাজসাক্ষীর সুবিধা ও রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য

আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, “রাষ্ট্র অনেক সময় আসামিকে অফার দেয় যে, তুমি যদি অপরদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দাও, তাহলে তোমার বিরুদ্ধে আর অভিযোগ তোলা হবে না। এতে রাষ্ট্রপক্ষ একটি শক্তিশালী সাক্ষ্য পায়, অপরদিকে সেই ব্যক্তি শাস্তি থেকে মুক্তি পাওয়ার সুযোগ পান।”

অন্য আসামিদের অবস্থান

তবে সাবেক আইজিপির দোষ স্বীকারে অন্য আসামিদের দায় প্রমাণিত হয় না বলে মত দিয়েছেন রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন। তিনি বলেন, “দশজনের মধ্যে একজন দোষ স্বীকার করলেই বাকিরাও দোষী—এমনটা বলা যায় না। সবার নিজ নিজ দায় প্রমাণ করতে হবে।”

অভিযোগের বিবরণ

প্রসিকিউশনের অভিযোগ অনুযায়ী, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময়, বিশেষ করে জুলাই ও আগস্ট মাসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে প্রায় ১,৫০০ মানুষ নিহত হন, ২৫,০০০ জন আহত হন এবং অনেকেই স্থায়ীভাবে পঙ্গু হয়ে যান। শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে হত্যা, ষড়যন্ত্র, উসকানি, পরিকল্পনা এবং ‘সুপিরিয়র রেসপন্সিবিলিটি’সহ পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়েছে।

বিচার প্রক্রিয়ার অগ্রগতি

১২ মে তদন্ত সংস্থা শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে রিপোর্ট দাখিল করে। ১ জুন ট্রাইব্যুনাল অভিযোগ আমলে নেয়। ১ জুলাই প্রসিকিউশন তাদের বিরুদ্ধে বিচার শুরুর আবেদন করে। অবশেষে বিচারপতি গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন ট্রাইব্যুনাল চার্জ গঠনের নির্দেশ দেয় এবং সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য আগামী ৩ ও ৪ আগস্ট তারিখ ধার্য করে।

চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন দোষ স্বীকার করায় তাকে চার্জ থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এখন তাকে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী হিসেবে উপস্থাপন করা হবে।

No comments

Powered by Blogger.