মানুষ পর্নোগ্রাফিতে এত আসক্ত কেন?
পর্নোগ্রাফি নিয়ে আলোচনা আজও অনেক জায়গায় কেবল কৌতূহলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। সমাজে এটি নিষিদ্ধ, পরিবারে এটি আড়ালে রাখা হয়। অথচ, ইন্টারনেট খুললেই যেকোনো বয়সের মানুষের কাছে এই জগৎ সহজেই পৌঁছে যায়।
তাহলে প্রশ্ন হলো—বাস্তবতা থেকে দূরে থাকা এবং অনেক সময় নিজেই বিরক্তিকর মনে হওয়া এই কনটেন্ট মানুষ বারবার দেখছে কেন? এটা কি কেবল শখ? না কি এর পেছনে রয়েছে আরও গভীর মানসিক, সামাজিক এবং প্রযুক্তিনির্ভর কিছু কারণ?
বিলিয়ন ডলারের বাজার
আজকের দিনে পর্নোগ্রাফি আর শুধুই গোপন বিনোদনের মাধ্যম নয়। এটি এখন একটি বিশাল বাণিজ্যিক শিল্প। যুক্তরাষ্ট্রে ২০২২ সালে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য তৈরি পর্নো ওয়েবসাইটগুলো থেকে আয় হয়েছে প্রায় ১.১ বিলিয়ন ডলার—বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা। গত পাঁচ বছরে এই বাজার গড়ে ১৪.১ শতাংশ হারে বেড়েছে, যা দেখায়—এই কনটেন্টের প্রতি মানুষের আগ্রহও বাড়ছে।
তরুণেরা সবচেয়ে ঝুঁকিতে
২০১৯ সালে ব্রিটেনে করা এক জরিপে দেখা যায়, ১৮ থেকে ২৫ বছর বয়সী ৭৭ শতাংশ পুরুষ এবং ৪৭ শতাংশ নারী জরিপের আগের মাসে পর্নো দেখেছেন। অথচ তাদের অনেকেই স্বীকার করেছেন, বাস্তব জীবনের যৌনতা আর পর্নোতে যা দেখা যায় তার মধ্যে কোনো মিল নেই।
অর্থাৎ, সবাই জানে এটি কল্পনার জগৎ—তবুও মানুষ তাতে ডুবে যাচ্ছে কেন?
নিষিদ্ধের প্রতি আকর্ষণ এবং মস্তিষ্কের প্রতিক্রিয়া
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আহমেদ হেলাল বলেন, মানুষের মনে নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি একটি স্বাভাবিক কৌতূহল এবং টান থাকে। পর্নোগ্রাফির ক্ষেত্রেও সেটি প্রযোজ্য।
তিনি জানান, পর্নো দেখার সময় মানুষের মস্তিষ্কে ডোপামিন এবং এন্ডোরফিন নামক হরমোন নিঃসৃত হয়, যা তাৎক্ষণিক আনন্দ, উত্তেজনা এবং স্বস্তির অনুভূতি তৈরি করে। এই ভালো লাগার অনুভূতি মানুষকে আবারও সেই কনটেন্টে ফিরিয়ে নিয়ে যায়।
শিক্ষার অভাব, একাকিত্ব ও বিকৃত ধারণা
বিশেষজ্ঞরা আরও কিছু কারণ চিহ্নিত করেছেন, যার ফলে তরুণদের মধ্যে পর্নোআসক্তি তৈরি হয়:
-
যৌনতা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা না থাকা
-
হস্তমৈথুন বা যৌন আকাঙ্ক্ষা নিয়ে লজ্জা ও ভয়
-
ভুল তথ্য এবং বিকৃত কল্পনার ওপর ভিত্তি করে তৈরি ফ্যান্টাসি
-
পরিবারে “না” বলার সংস্কৃতি এবং একাকিত্ব
যখন একজন তরুণ বাইরে ঘোরাঘুরি করতে পারে না, বন্ধু তৈরি করতে পারে না, তখন সে নিজের মোবাইলেই খুঁজে নেয় আনন্দের পথ। আর সেখান থেকেই শুরু হয় পর্নোগ্রাফির জগতে প্রবেশ। ধীরে ধীরে তা হয়ে ওঠে একঘেয়েমি কাটানোর সহজ পন্থা। একসময় তা আসক্তির রূপ নেয়।
‘ভয় নয়, দরকার আলোচনা’—বলছেন বিশেষজ্ঞরা
ইনস্টিটিউট অব সাইকোসেক্সুয়াল মেডিসিনের সদস্য ডা. কেট হাওয়েলস বলেন, পর্নোগ্রাফি নিয়ে প্রশ্ন করতে ভয় পেলে চলবে না। মানুষ কী দেখে, কেন দেখে—সেটা বোঝার পাশাপাশি দরকার শিক্ষার।
তিনি মনে করেন, যৌনশিক্ষার অংশ হিসেবে পর্নোগ্রাফি সম্পর্কেও আলোচনা থাকা উচিত। কারণ এই ধরণের কনটেন্ট আমাদের বাস্তব সম্পর্ক, পারস্পরিক সম্মান এবং নারী-পুরুষের ভূমিকা সম্পর্কেও প্রভাব ফেলে।
এ কারণে যুক্তরাজ্যের ওয়েলস প্রদেশে ২০২২ সাল থেকে পাঠ্যক্রমে যৌনতা ও সম্পর্ক নিয়ে শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
পর্নোআসক্তি থেকে বের হওয়ার উপায়
ডা. আহমেদ হেলাল কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক উল্লেখ করেছেন, যেগুলো পর্নোগ্রাফির প্রতি আসক্তি কমাতে সাহায্য করতে পারে:
-
বিজ্ঞানভিত্তিক যৌনশিক্ষা
-
বিকল্প আনন্দের উৎস খোঁজা (যেমন: গান, সিনেমা, খেলাধুলা, শরীরচর্চা)
-
পরিবার এবং সমাজে খোলামেলা আলোচনা
-
শুধু ওয়েবসাইট বন্ধ নয়, বরং ভেতরের চাহিদা কমানোর চেষ্টা
-
ধর্মীয় অনুশাসন ও নৈতিক মূল্যবোধের চর্চা
তবে, এই কৌশলগুলো হতে হবে দীর্ঘমেয়াদি এবং সহানুভূতিশীল। কেবল “না” বলেই সমাধান আসবে না। তৈরি করতে হবে বিশ্বাস এবং বিকল্প চিন্তার সুযোগ।
No comments