২০২৫-২৬ বাজেট বিশ্লেষণ
বাংলাদেশের ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট কিছুদিন আগে পেশ হয়েছে। এর পর থেকেই বরাবরের মতোই শুরু হয়েছে নানা বিশ্লেষণ। সংবাদমাধ্যম, অর্থনীতিবিদ, বিশেষজ্ঞ ও বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠন বাজেটের নানা দিক বিশ্লেষণ করছে। কেউ কেউ এই বাজেটকে ইতিবাচক বলেছেন, আবার কেউ কেউ এতে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। প্রত্যেক বছরই বাজেট নিয়ে এমন ভিন্নমত দেখা যায়, কারণ সবাইকে সন্তুষ্ট করা কখনোই সম্ভব নয়।
একটি নির্বাচিত সরকারের বাজেট সাধারণত দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তৈরি হয়। কিন্তু একটি অন্তর্বর্তী সরকারের বাজেটের ক্ষেত্রে এই ধারা প্রযোজ্য নয়। তাই এবারের বাজেটটি দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গির বদলে স্বল্পমেয়াদি লক্ষ্য অর্জনের ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। সরকার এটিকে উচ্চাভিলাষী নয়, বরং বাস্তবভিত্তিক বাজেট বলেছে।
তবুও প্রশ্ন থেকে যায়—এই বাজেটের পেছনে কী ধরনের উন্নয়ন দর্শন রয়েছে? বাজেটটি কি মানব উন্নয়নকেন্দ্রিক, নাকি প্রবৃদ্ধিকেন্দ্রিক? যদিও এটিকে 'মানবকেন্দ্রিক' বলা হয়েছে, কিন্তু শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে বরাদ্দ কমানো হয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষায় বরাদ্দ কমেছে এবং স্বাস্থ্য খাতেও প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। কৃষি খাত, যা দেশের ৪৪ শতাংশ কর্মসংস্থান নিশ্চিত করে, সেটির জন্য বরাদ্দ মোট উন্নয়ন বাজেটের মাত্র ৫ শতাংশেরও কম। এসব দিক বিবেচনায় বাজেটের মানব উন্নয়নকেন্দ্রিকতা প্রশ্নবিদ্ধ।
অন্যদিকে, বাজেটটি প্রবৃদ্ধিকেন্দ্রিক কি না, তাও স্পষ্ট নয়। পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে সর্বোচ্চ ২৬ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, কিন্তু সেটি প্রকৃত প্রবৃদ্ধি অর্জনের উদ্দেশ্যে কি না, তা পরিষ্কার নয়। বিনিয়োগ বাড়ানো এবং কর্মসংস্থান তৈরি করা—এই দুইটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও বাজেটে তেমন স্পষ্ট কোনো পরিকল্পনা নেই। অথচ দেশে বেকারের সংখ্যা প্রায় ৩০ লাখ এবং চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে ২০ লাখ কর্মসংস্থান হারিয়ে গেছে।
প্রবৃদ্ধির হার ৫.৫ শতাংশ এবং মূল্যস্ফীতি ৬.৫ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে বাজেটে। তবে বর্তমানে প্রবৃদ্ধির হার ৩.৯ শতাংশ এবং মূল্যস্ফীতি প্রায় ৯ শতাংশ। বাস্তব অবস্থা বিবেচনায় এসব লক্ষ্যমাত্রা অনেকেই উচ্চাশা হিসেবে দেখছেন। যদি এই লক্ষ্যমাত্রাগুলো অর্জিত না হয়, তাহলে বাজেটের আর্থিক কাঠামো ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া মারাত্মকভাবে ব্যাহত হতে পারে। এমনকি দারিদ্র্যের হারও বেড়ে যেতে পারে—প্রায় ৩৯ লাখ মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এর মধ্যেই জানা গেছে, এপ্রিল পর্যন্ত রাজস্ব আহরণ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ৩৮ শতাংশ কম হয়েছে। ঋণ পরিশোধ এবং ভর্তুকির চাপে ব্যয় বাড়ছে। ফলে সরকারকে হয়তো আরও বেশি রাজস্ব আহরণ করতে হবে। কিন্তু প্রত্যক্ষ কর সংগ্রহের সক্ষমতা সীমিত হওয়ায়, সরকার হয়তো মূল্য সংযোগ কর (VAT) ও আবগারি শুল্কের মতো অপ্রত্যক্ষ কর বাড়াতে পারে। আর অর্থের ঘাটতি মেটাতে শেষ পর্যন্ত ঋণ নেওয়া বা মুদ্রা ছাপানোর পথেও যেতে হতে পারে।
এবারের বাজেটে নারীর অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ বৃদ্ধি বা জেন্ডার সংবেদনশীল নীতির দিকটিও গুরুত্ব পায়নি, যা বিস্ময়কর। অথচ এই বিষয়ে অতীতে নানা আলোচনা ও অগ্রগতি ছিল। আশা করা যায়, বাজেটের সংশোধনী প্রক্রিয়ায় এসব বিষয় নতুন করে গুরুত্ব পাবে।
সব মিলিয়ে, ২০২৫-২৬ সালের বাজেটটি একটি বাস্তববাদী প্রয়াস হতে পারে, কিন্তু তাতে সুস্পষ্ট উন্নয়ন দর্শনের অভাব রয়েছে। বাজেটটি neither প্রবৃদ্ধিনির্ভর, nor মানব উন্নয়নভিত্তিক—এই দুইয়ের মাঝামাঝি এক অস্পষ্ট পথে হাঁটছে।
No comments