নির্বাচনী জোট গঠনে ভাবনায় বিএনপি
লন্ডনে অনুষ্ঠিত বৈঠকের পর আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা অনেকটাই কেটেছে বলে মনে করছে বিএনপি ও ফ্যাসিবাদবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের শরিকরা। আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে ধরে নিয়েই শরিক দলগুলোর শীর্ষ নেতারা নির্বাচনী প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছেন। যদিও এখনো আসন ভাগাভাগির বিষয়টি চূড়ান্ত হয়নি, তবে নেতারা নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় সাংগঠনিক কার্যক্রম জোরদার করেছেন। চলছে সুধী সমাবেশ ও প্রাথমিক গণসংযোগ কর্মসূচি।
তবে আসন বণ্টন নিয়ে শরিকদের সঙ্গে এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো আলোচনা করেনি বিএনপি। দলটি মনে করছে, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর এ বিষয়ে আলোচনা শুরু করাই হবে উপযুক্ত সময়। গত রোববার গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে এক বৈঠকে বিএনপি এমন ইঙ্গিতও দিয়েছে।
বোনাস পেতে ক্লিক করুন
বিএনপি ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, লন্ডনে ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মধ্যে ফলপ্রসূ বৈঠকের পর দেশের রাজনীতিও এখন নির্বাচনমুখী। এই বাস্তবতায় বিএনপি একটি নির্বাচনী জোট গঠন নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করেছে। শরিক দলগুলোর পক্ষ থেকেও এখন নির্বাচনী জোট ও আসন বণ্টন নিয়ে স্পষ্ট বার্তার প্রত্যাশা করা হচ্ছে।
জানা গেছে, আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই বিএনপি নির্বাচনী জোট গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করতে পারে। যেসব দল যুগপৎ আন্দোলনে যুক্ত ছিল কিন্তু এককভাবে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাদের বাদ দিয়ে বাকিদের নির্বাচনী জোটে রাখার পরিকল্পনা করছে দলটি। এমনকি যুগপতের বাইরে থাকা কিছু দল, যেমন জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-কেও জোটে অন্তর্ভুক্ত করার কথা ভাবা হচ্ছে, যদি তারা আগ্রহ দেখায়।
বিএনপির লিয়াজোঁ কমিটির সদস্য ও স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, বিএনপি ঘোষিত ৩১ দফায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, একটি অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট সরকারকে হটিয়ে জনগণের সরকার গঠনে অংশ নেওয়া দলগুলোর সমন্বয়ে জাতীয় ঐকমত্যের সরকার গঠিত হবে। তিনি বলেন, এই কমিটমেন্ট রয়ে গেছে, তবে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরই আসন বণ্টনের মতো বিষয়গুলো নির্ধারিত হবে।
ফ্যাসিবাদবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনে বিএনপির নেতৃত্বে অন্তত ৪০টি রাজনৈতিক দল সম্পৃক্ত রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—গণতন্ত্র মঞ্চ (ছয় দলীয়), ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট (১০ দলীয়), গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য, এলডিপি, গণফোরাম-বিপিপি, গণঅধিকার পরিষদ, বাংলাদেশ লেবার পার্টি এবং এনডিএম। এসব দলের মধ্যে যাদের জাতীয় পরিচিতি আছে বা যারা সংশ্লিষ্ট এলাকায় জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা রাখে, তাদেরই অগ্রাধিকার দিয়ে আসন ছাড়তে পারে বিএনপি। এমনকি জোটের ঐক্য রক্ষার স্বার্থেও কিছু আসন ছাড়ার কথা ভাবছে দলটি।
২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি জামায়াতে ইসলামীর জন্য ২২টি আসন ছেড়ে দিয়েছিল। তবে এবার জামায়াত এককভাবে নির্বাচনে অংশ নিতে পারে বলে জানা গেছে, তাই তাদের সঙ্গে আসন বণ্টনের কোনো আলোচনা হচ্ছে না। অন্যদিকে, ২০১৮ সালের নির্বাচনী জোটে না থাকা কিছু দল পরবর্তীতে যুগপৎ আন্দোলনে যুক্ত হয়েছে। তারা জোটে এলে বিএনপি তাদেরও আসন দিতে পারে।
এই নির্বাচনে বিএনপির শরিকদের জন্য আসন ছাড়ার সংখ্যা ৫০টির নিচে থাকবে বলে জানা গেছে, যেখানে ২০১৮ সালে এই সংখ্যা ছিল ৫৯টি। এনসিপি প্রসঙ্গে জানা গেছে, দলটি গঠনের পর থেকেই বিএনপি তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রাখার চেষ্টা করেছে। মাঝখানে কিছু মতপার্থক্য তৈরি হলেও বৃহত্তর স্বার্থে এনসিপিকে নির্বাচনী জোটে নেয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এমনকি কিছু যোগ্য নেতাকে আসন দেওয়ার বিষয়েও চিন্তা করা হচ্ছে।
বিএনপি ও এনসিপির মধ্যে এক পর্যায়ে এ বিষয়ে একটি তালিকা চাওয়া হয়েছিল। যদিও পরে এ নিয়ে অগ্রগতি হয়নি, তবে রাজনৈতিক বাস্তবতায় সবকিছু পরিবর্তন হতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
এদিকে গত রোববার বিএনপি গুলশানে চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করেছে। মূলত লন্ডন বৈঠক সম্পর্কে মঞ্চের নেতাদের অবহিত করতেই এই বৈঠক হয়। ছয় দলীয় এই জোট বিএনপি-ইউনূস বৈঠক নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে। তবে আলোচনায় আসন বণ্টন নিয়েও কথা হয়।
বিএনপির পক্ষ থেকে বৈঠকে জানানো হয়, যুগপৎ আন্দোলনের মিত্রদের নিয়েই বিএনপি আগামীতে নির্বাচন করবে এবং তারা সরকার গঠনের অংশীদার হবে। নির্বাচন ঘনিয়ে এলে প্রার্থিতা ও মনোনয়ন নিয়ে আলোচনায় বসবে বিএনপি। একই সঙ্গে দলের পক্ষ থেকে বলা হয়, ধানের শীষের মনোনয়ন পেলে সংশ্লিষ্ট এলাকায় অন্য কেউ দলের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলে তার বিরুদ্ধে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বৈঠকে বিএনপির পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু। গণতন্ত্র মঞ্চের পক্ষে ছিলেন সমন্বয়ক ও ভাসানী জনশক্তি পার্টির চেয়ারম্যান শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী হাসনাত কাইয়ূম এবং জেএসডির সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন।
বৈঠক শেষে গণতন্ত্র মঞ্চের সমন্বয়ক শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু বলেন, বিএনপি বারবার আশ্বস্ত করেছে যে, যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের সঙ্গে নিয়েই তারা নির্বাচন করবে এবং সরকার গঠন করবে। আশা করা হচ্ছে, সময়মতো আসন বণ্টন নিয়ে আলোচনা শুরু হবে।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাইফুল হক বলেন, যুগপৎ আন্দোলনের ঐক্য নির্বাচনের মাধ্যমে আরও জোরদার হবে। এখনো নির্বাচনী জোটের রূপরেখা নিয়ে নির্দিষ্ট আলোচনা না হলেও, নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে এলে আলাপ-আলোচনা গভীর হবে এবং বোঝাপড়াও বাড়বে। তিনি বলেন, আমরা চাই আন্দোলনের সব শক্তি নিয়েই ঐক্য বজায় থাকুক।
No comments