১২ সিটিতে ভোট নিয়ে সরকারের ভাবনা
জাতীয় নির্বাচনের আগে দেশের ১২টি সিটি করপোরেশনে ভোট আয়োজন নিয়ে নতুন করে ভাবছে সরকার। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, নাগরিক সেবা সচল রাখতে এই নির্বাচন জরুরি। একইসঙ্গে এটি জাতীয় নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশনের জন্য ‘ট্রায়াল রান’ হিসেবেও কাজ করতে পারে। দ্রুতই সরকারের পক্ষ থেকে এই নির্বাচনের ঘোষণা আসতে পারে।
তবে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আগে, না স্থানীয় সরকার নির্বাচন—এ নিয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য এখনো হয়নি। বিএনপির মতো বড় রাজনৈতিক দল জাতীয় নির্বাচন আগে চায়। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, গণঅধিকার পরিষদ, এবি পার্টিসহ বেশ কয়েকটি দল জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকারের ভোট চায়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনৈতিক ঐকমত্য ছাড়া স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজন অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে। স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. তোফায়েল আহমেদ বলছেন, বিচ্ছিন্নভাবে সিটি করপোরেশন নির্বাচন করাটা ভুল হবে। আগে কিছু সংস্কার করে, একক সময়সূচিতে সব স্থানীয় সরকার নির্বাচন করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে। তাঁর মতে, এই সংস্কারে সর্বোচ্চ এক মাস সময় লাগবে।
২০২৩ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনসহ ১২টি সিটির মেয়র ও কাউন্সিলরদের অপসারণ করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। পরবর্তীতে সেবা ব্যাহত হওয়ায় আইন সংশোধন করে প্রশাসক নিয়োগ দেয় সরকার। এর মধ্যে চট্টগ্রামে আদালতের রায়ে বিএনপির শাহাদাত হোসেন মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন। তবে আন্দোলন সত্ত্বেও ঢাকা দক্ষিণে বিএনপির ইশরাক হোসেন শপথ নিতে পারেননি।
আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে, স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইনের ৩৪(১)(খ) ও ৩৪(১)(গ) ধারায় নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
সর্বশেষ সিটি করপোরেশন ভোটগুলো হয়েছে:
-
ঢাকা (উত্তর ও দক্ষিণ): ১ ফেব্রুয়ারি ২০২০
-
চট্টগ্রাম: ২৯ মার্চ ২০২০
-
নারায়ণগঞ্জ: ১৬ জানুয়ারি ২০২২
-
কুমিল্লা: ১৫ জুন ২০২২
-
রংপুর: ২৭ ডিসেম্বর ২০২২
-
গাজীপুর: ২৫ মে ২০২৩
-
খুলনা ও বরিশাল: ১২ জুন ২০২৩
-
রাজশাহী ও সিলেট: ২১ জুন ২০২৩
-
ময়মনসিংহ: ৯ মার্চ ২০২৪
স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া মনে করেন, নাগরিক সেবা সচল রাখতে এখনই সিটি করপোরেশন নির্বাচন দরকার। জাতীয় নির্বাচনের সময় নির্ধারিত হয়ে গেছে, তাই তার আগে এই নির্বাচন আয়োজন যৌক্তিক হবে। এতে জনগণের দুর্ভোগ কমবে। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও নির্বাচন কমিশনের দক্ষতা যাচাইয়ের সুযোগও মিলবে।
সম্প্রতি উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সিদ্ধান্ত হয়েছে, যদি বিএনপির ইশরাক হোসেন নগর ভবনে বিশৃঙ্খলা বন্ধ না করেন, তবে সরকার স্থানীয় নির্বাচনের দিকে এগোবে। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক দল যেমন জামায়াত, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলনও এই নির্বাচনের পক্ষে।
নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ জানান, জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি নিচ্ছে ইসি। তবে সরকার চাইলে জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচনও আয়োজন করা হবে। স্থানীয় সরকারের কোন স্তরে ভোট হবে, সেই সিদ্ধান্ত নেবে সরকার। ইসি তখন দায়িত্ব পালন করবে সুষ্ঠুভাবে।
রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিক্রিয়া:
-
বিএনপি: আগে জাতীয় নির্বাচন চাই। সিটি করপোরেশন নির্বাচনের এখন প্রয়োজন নেই— বললেন ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু।
-
জামায়াতে ইসলামী: ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারির মধ্যে জাতীয় নির্বাচন চাই। তবে আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হোক— বললেন সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের।
-
এনসিপি: দ্রুত নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করে স্থানীয় নির্বাচন আয়োজন করা হোক। গণপরিষদ ও জাতীয় নির্বাচনের তারিখ একসঙ্গে ঘোষণা দিতে পারে সরকার— মত নাহিদ ইসলাম।
-
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ: জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন হওয়া যুক্তিসংগত। নাগরিকরা সেবা পাচ্ছেন না— বললেন গাজী আতাউর রহমান।
-
জাতীয় পার্টি: সরকার থেকে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এলে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে দল— বললেন জিএম কাদের।
-
হেফাজতে ইসলাম: কোন নির্বাচন আগে হবে, তা সরকার বিবেচনা করুক— মন্তব্য মুহিউদ্দিন রাব্বানীর।
-
গণঅধিকার পরিষদ: স্থানীয় নির্বাচন আগে চাই, কারণ প্রশাসনে এখনো অস্থিরতা ও দলীয়করণ রয়ে গেছে। স্থানীয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে প্রশাসনের অ্যাসিড টেস্ট হবে— বললেন নুরুল হক নুর।
-
এবি পার্টি: সিটি করপোরেশন নির্বাচন নির্বাচন কমিশনের জন্য ভালো অভিজ্ঞতা হতে পারে। একই সঙ্গে নাগরিকদের সেবা ফেরানো সম্ভব হবে— বললেন মজিবুর রহমান মঞ্জু।
বিশ্লেষকদের মত:
-
আবু আলম শহীদ খান (সাবেক সচিব): রাজনৈতিক ঐকমত্য ছাড়া স্থানীয় নির্বাচন আয়োজন করলে আস্থার সংকট তৈরি হবে, যা সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ হবে।
-
ড. তোফায়েল আহমেদ (সংস্কার কমিশনের প্রধান): সিটি করপোরেশন নির্বাচন আলাদাভাবে নয়, বরং সব স্থানীয় নির্বাচন একসাথে করতে হবে। এক মাসে সংস্কার সম্ভব। এতে শূন্যতা দূর হবে, প্রশাসনিক সক্ষমতা বাড়বে এবং জাতীয় নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি হবে।
No comments