Header Ads

ইউনূস-তারেকের বৈঠক: দেশের জন্য স্বস্তির বার্তা

 

ইউনূস-তারেকের বৈঠক: দেশের জন্য স্বস্তির বার্তা


 

একটি বৈঠকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্য বদলে গেছে। অনিশ্চয়তার মেঘ কেটে গেছে, আর সূর্যের আলো দেশের ওপর পড়েছে। তীব্র দাবদাহের পর ঝুম বৃষ্টি মতো স্বস্তি এসেছে দেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের লন্ডন বৈঠক সব সংশয় কাটিয়ে নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলেছে। বলা যায়, এই দুই ঘণ্টার ঐতিহাসিক বৈঠক ষড়যন্ত্রকারীদের জন্য ‘গেম ওভার’ মুহূর্ত ছিল। এটি শুধু উভয়ের জন্য নয়, পুরো দেশের জন্য এক বিজয়।

জাতি আগ্রহ নিয়ে এই বৈঠকের অপেক্ষায় ছিল। ঘোষণা দেওয়ার পর থেকেই সবাই মুহূর্তে মুহূর্তে নজর রাখছিল। বৈঠকের মূল বিষয় ছিল আগামী নির্বাচন। এ সমস্যার সমাধান হয়েছে খুবই সাবলীলভাবে। নির্বাচন ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে করার সম্ভাবনার ওপর দুই পক্ষই সয়ম দিয়েছে। বিএনপি ‘ডিসেম্বরেই নির্বাচন’ হবে—এই অবস্থান থেকে সরে এসেছে। অন্তর্বর্তী সরকার ‘এপ্রিলেই নির্বাচন’ হবে—এ অবস্থানেও অনড় ছিল না। দুই নেতা বিচক্ষণতা ও প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়ে সবাইকে আশ্বস্ত করেছেন। তাই ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও তারেক রহমানকে ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য বলা যায়। তারা প্রমাণ করেছেন, দেশের মানুষ প্রয়োজনে ঐক্যবদ্ধ হতে পারে এবং কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে পারে। ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড়—এই মূল্যবোধও তারা তুলে ধরেছেন।

বৈঠকের পর যৌথ ঘোষণায় বলা হয়েছে, ‘বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডনে সফররত প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সৌহার্দ্যমূলক বৈঠক করেছেন।’ তারেক রহমান প্রধান উপদেষ্টাকে আগামী বছরের রমজানের আগে নির্বাচন করার প্রস্তাব দেন। দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াও এ সময় নির্বাচন হওয়াই ভালো মনে করেন।

ঘোষণায় আরও বলা হয়, প্রধান উপদেষ্টা এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচন ঘোষণার কথা জানিয়েছেন। প্রস্তুতি সম্পন্ন হলে রোজা শুরুর আগের সপ্তাহেও নির্বাচন করা যেতে পারে। তবে তার আগে সংস্কার ও বিচারে যথেষ্ট অগ্রগতি থাকতে হবে। তারেক রহমান প্রধান উপদেষ্টার এ অবস্থানকে স্বাগত জানান ও ধন্যবাদ জানিয়েছেন। প্রধান উপদেষ্টাও তারেক রহমানকে ফলপ্রসূ আলোচনার জন্য ধন্যবাদ দিয়েছেন।

বৈঠকের শুরু থেকেই দুই নেতা হৃদ্যতার পরিবেশ তৈরি করতে সচেষ্ট ছিলেন। সফল বৈঠকের জন্য উভয়েই আন্তরিক ছিলেন। বৈঠকের আগের মুহূর্ত থেকে তাদের আন্তরিকতা স্পষ্ট ছিল। তারেক রহমান হোটেলে পৌঁছে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন, ড. ইউনূস তারেকের সঙ্গে হ্যান্ডশেক দিয়ে স্বাগত জানান। বিএনপি মিডিয়া সেল ওই মুহূর্তের একটি ভিডিও প্রকাশ করেছে, যেখানে দেখা যায় তারা উষ্ণ আলাপ করছেন। তারেক বলেন, ‘এটা আমার জন্য আসল সম্মান।’ তিনি প্রধান উপদেষ্টাকে ঈদের শুভেচ্ছাও জানান।

বৈঠকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। তারেক রহমান প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সবার পরিচয় করিয়ে দেন। ড. ইউনূস সবার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করেন। তারেক প্রধান উপদেষ্টার স্বাস্থ্যের খোঁজ নেন, উত্তরে তিনি জানান, ‘চলছে, টেনেটুনে।’ তারেক রহমান বিএনপি চেয়ারপারসনের সালাম পৌঁছে দেন এবং প্রধান উপদেষ্টা তা গ্রহণ করেন।

তাদের মধ্যে লন্ডনের আবহাওয়া নিয়েও সংলাপ হয়। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আবহাওয়া খুব ভালো, এখানে অনেকদিন আছি, বেশ উপভোগ করেছি।’ তারেক জানতে চান, ‘আপনি পার্কে গিয়েছেন?’ উত্তরে তিনি জানান, ‘এখানে হাঁটার অনেক ভালো স্থান আছে।’

এই মনোরম শুরু থেকে সফল বৈঠকের সম্ভাবনা স্পষ্ট ছিল। দুই নেতার প্রথম সাক্ষাৎ অত্যন্ত ইতিবাচক ছিল।

তবে মনে রাখা দরকার, ইউনূস ও তারেক কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে এসেছেন। ফ্যাসিবাদের আমলে তারা নির্মম নিগ্রহের শিকার হয়েছেন। ভুয়া ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলায় দুজনেই কষ্টসহকারে নির্যাতিত হয়েছেন। তারেকের ওপর ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারির পর যে দমন চালানো হয়েছিল, তা কল্পনাও করা যায় না। তিনি মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছিলেন এবং দীর্ঘ চিকিৎসা নিতে হয়েছে। ড. ইউনূসও বৃদ্ধ বয়সেও কারাগারের কষ্ট সহ্য করেছেন। এসব কারণে তারা ফ্যাসিবাদ চিরতরে নির্মূল করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। ফ্যাসিবাদের পরবর্তী শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য তারা সর্বোচ্চ প্রস্তুত।

বৈঠকে তারেক রহমান একজন জাতীয় নেতার মতো আত্মপ্রকাশ করেন। তার গম্ভীরতা, রাজসিকতা এবং সাবলীলতা তাকে ভরসার প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। লন্ডনে বৈঠক সফল করে তিনি রাজনীতিবিদ হিসেবে নিজের অবস্থান শক্ত করেছেন। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া যদিও বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন না, তার উপস্থিতি ও প্রভাব পুরো সময়ই স্পষ্ট ছিল। তিনি দেশের অবিসংবাদিত নেত্রী হিসেবে জাতির কাছে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের চার দিনের লন্ডন সফরও অনেক অর্জন নিয়ে এসেছে। প্রধান উপদেষ্টা রাজা চার্লসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন, ব্রিটেনে শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ সহযোগীর সম্পদ জব্দের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছেন, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে কাজ করেছেন।

এই বৈঠক বাংলাদেশপন্থিদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। অন্তর্ঘাতকারীদের দুঃস্বপ্ন শেষ হয়েছে। যদি জুলাই ঘোষণাপত্র, সংস্কার, বিচার এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়ে এই বোঝাপড়া অব্যাহত থাকে, তাহলে দেশের বিজয় নিশ্চিত।

দুই নেতা সব অনিশ্চয়তা কাটিয়ে জাতিকে সামনে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছেন। তাদের বার্তা হলো—এখন জাতীয় ঐক্য দরকার। বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক পথে এগিয়ে যাচ্ছে। বিষোদগার না করে সবাইকে ঐকমত্যের ভিত্তিতে দেশের উন্নয়নে কাজ করতে হবে।

গত ১৫ বছরে বাংলাদেশের গণতন্ত্র উত্তরণের সুযোগ পেয়েছে। এ সফলতা জনগণের প্রত্যাশা পূরণে সহায়ক হবে। মানুষ তার ভোটাধিকার ফিরে পাবে। দেশের গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে দ্রুত নির্বাচন অপরিহার্য। সংস্কার ও বিচারে আরও দৃঢ়তার সঙ্গে কাজ করা সম্ভব হবে।

জনগণ শুধু কথায় নয়, বাস্তবে সংস্কার ও বিচার দেখতে চায়। তাই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা ভিত্তিক জাতীয় ঐক্য তৈরি গুরুত্বপূর্ণ।

দেশবাসী শুরু থেকেই সংলাপ ও সমঝোতার ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। অধ্যাপক ইউনূস ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে চান না। বিএনপিও সংস্কারবিরোধী নয়। তবে একে অপরের প্রতি সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছিল। এই লন্ডন বৈঠক সব সংকট দূর করেছে।

আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে এখন আর সংকট নেই। এটি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার এবং গণতন্ত্রের পথে অগ্রসর হওয়ার মাইলফলক।

নেতারা বলেছেন, আগামী রমজানের আগে নির্বাচন করার ঐকমত্য দেশের মানুষের জন্য স্বস্তির বার্তা।

বাংলাদেশ আশা করতে পারে, সব রাজনৈতিক দলের ঐক্যমতে জুলাই সনদ প্রকাশ হবে। নির্বাচনের আগে প্রয়োজনীয় সংস্কার ও গণহত্যার বিচার হবে। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও বিদেশি প্রভাবমুক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

এ সরকার শুধু নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক নয়, জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন।

জুলাই ঘোষণাপত্র ও সনদ, মৌলিক সংস্কার, দৃশ্যমান বিচার এবং নির্বাচনকেন্দ্রিক সংস্কার গুরুত্বপূর্ণ।

গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর মানুষ নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিল, যা নতুন স্বাধীনতার মতো ছিল। দেশকে নতুনভাবে গড়ার স্বপ্ন দেওয়ালে আঁকা হয়েছিল। আশা করা যায়, সেই স্বপ্ন আবার বাস্তবে প্রতিফলিত হবে এবং দেশের জাতীয় জীবনে প্রাণ ফিরিয়ে আনবে।

No comments

Powered by Blogger.