আ.লীগ নেতাকে সুবিধা দিতে শত কোটি টাকার পাথর দেওয়া হলো
সিলেটের কানাইঘাট সীমান্তে অবস্থিত লোভা নদী থেকে জব্দ করা এক কোটি পাঁচ হাজার ঘনফুট পাথরের নিলামে বড় ধরনের অনিয়ম হয়েছে। প্রায় ১০০ কোটি টাকার পাথর নিলামের মাধ্যমে মাত্র ১৭ কোটি টাকায় তুলে দেওয়া হয়েছে আওয়ামী লীগ নেতা মোস্তাক আহমদ পলাশের নেতৃত্বাধীন একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের হাতে।
গোপনে বিক্রি করা হলো কোটি টাকার সম্পদ
খনিজসম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো (বিএমডি) এর একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগসাজশে এই নিলাম সম্পন্ন হয়। অভিযোগ রয়েছে, প্রায় ৫৬ লাখ ঘনফুট পাথর গোপন রেখে নিলাম কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে। স্থানীয় বাজারে এই পাথরের প্রকৃত মূল্য ১০০ কোটির বেশি হলেও, ৪৪ লাখ ঘনফুট পাথর মাত্র ২১ কোটি টাকায় নিলাম দেওয়া হয়।
আদালতের নিষেধাজ্ঞাও উপেক্ষিত
২০১৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতা মোস্তাক আহমদ পলাশ অবৈধভাবে বিশাল পরিমাণ পাথর মজুত করেন। এরপর সামী এন্টারপ্রাইজ নামে একটি প্রতিষ্ঠান নিলামের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আবেদন করে এবং আদালত নিলাম স্থগিতের আদেশ দেয়। কিন্তু বিএমডির কিছু কর্মকর্তা এই আদেশকে এড়িয়ে বিভিন্ন কৌশলে নথিপত্র তৈরি করেন এবং ‘রিট বহির্ভূত’ শব্দ ব্যবহার করে ৪৪ লাখ ঘনফুট পাথর নিলাম সম্পন্ন করেন।
কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে জড়িত থাকার অভিযোগ
বিএমডির পরিচালক (যুগ্ম সচিব) ছরোয়ার হোসেন এই নিলাম কার্যক্রমে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন বলে অভিযোগ রয়েছে। নিলাম কার্যাদেশ বাস্তবায়নের সময় তিনি বিজয়ী প্রতিষ্ঠানের দেওয়া গরুর ভোজেও অংশ নেন। জানা গেছে, যেসব এলাকা ‘মামলাবহির্ভূত’ বলা হয়েছে, সেখানে প্রকৃতপক্ষে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ পাথর ছিল না। গোপন রাখা ৫৬ লাখ ঘনফুট পাথর ছিল অন্যত্র।
রহস্যজনকভাবে পাঁচ বছর আগের দামে নিলাম
পাথর ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০১৯ সালে লোভাছড়া এলাকার পাথরের দাম ছিল প্রতি ঘনফুট ৯০ টাকা। বর্তমানে দাম ১২৫ টাকা হলেও, নিলাম সম্পন্ন করা হয় আগের দরে। এতে সরকারের বিশাল রাজস্ব ক্ষতির অভিযোগ উঠেছে।
ভিত্তিমূল্যে কারসাজির প্রমাণ
নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ৪৪ লাখ ঘনফুট পাথরের বাজারমূল্য প্রায় ৫৫ কোটি টাকা হলেও, ভিত্তিমূল্য ধরা হয়েছে মাত্র ৩৩ কোটি টাকা। পরে এটি কার্যকর করা হয় মাত্র ১৭ কোটি টাকায়। ফলে বিজয়ী প্রতিষ্ঠান বিশাল আর্থিক সুবিধা পায়।
সিন্ডিকেটের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ
নিলাম কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে, যার নেতৃত্বে ছিলেন সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মোস্তাক আহমদ পলাশ। ২০১৯ সালে তিনি বিএমডির কিছু কর্মকর্তার সহায়তায় এই পাথর মজুত করেন। পরে সেই একই কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় এসব পাথর পানির দরে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন।
গোপন সভা, গোপন চুক্তি
২০২৫ সালের ৪ মে অনুষ্ঠিত পাথর কোয়ারি ব্যবস্থাপনা কমিটির বৈঠকে জানানো হয় যে, মামলার বাইরে থাকা ৪৪ লাখ ২৩ হাজার ঘনফুট পাথর উন্মুক্ত নিলামের মাধ্যমে বিক্রি করা হয়েছে। এই বিক্রয় থেকে সরকারের কোষাগারে মাত্র ২১ কোটি টাকা জমা পড়েছে।
সরাসরি লাভবান কিছু কর্মকর্তা
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকৃত তথ্য গোপন করে নথিপত্র তৈরি করা হয়েছে এবং এতে সরকারের কমপক্ষে শত কোটি টাকার রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে। আর এর বিপরীতে কিছু কর্মকর্তা ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে, নিলাম ঘিরে বিশাল অঙ্কের টাকার ভাগবাটোয়ারা হয়েছে।
জবাব না দিয়ে ফোন কেটে দেন কর্মকর্তা
বিএমডির পরিচালক ছরোয়ার হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “এক ঘণ্টা পর কথা বলব।” পরে তিনি কল কেটে দেন এবং আর সাড়া দেননি।
বিএমডির মহাপরিচালকের মন্তব্য
বিএমডির মহাপরিচালক মো. আনোয়ার হাবীব বলেন, “লোভাছড়ার পাথর নিলাম সম্পর্কে আমি জানি। তবে কত পরিমাণ পাথর এবং কী দামে নিলাম হয়েছে, তা না দেখে সঠিকভাবে বলতে পারছি না।”
এই ঘটনার মাধ্যমে আবারও প্রমাণ হলো—সিস্টেমে স্বচ্ছতা না থাকলে কীভাবে রাষ্ট্রের সম্পদ ব্যক্তির পকেটে চলে যেতে পারে। বিষয়টি নিয়ে স্বাধীন তদন্ত দাবি করছেন সংশ্লিষ্ট মহল। কারণ, শুধু একজন নেতা নন, প্রশাসনের কিছু উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাও এ দুর্নীতিতে জড়িত বলে প্রমাণ মিলছে।
No comments