পৃথিবীর ঋতু কি আর আগের মতো নেই?
প্রকৃতি নিজের নিয়মে চলে—বসন্তে কোকিলের গান, বর্ষায় নদীর উথাল-পাথাল, শীতে নিঃশব্দ বিশ্রাম। এই ঋতুর পালাবদলে একসময় ছিল জীবনের নিখুঁত ছন্দ। কিন্তু আজ যেন সেই ছন্দে লাগছে ফাটল। ঋতুগুলোর নিয়মিত পরিবর্তন এখন আর আগের মতো নেই। পৃথিবীর প্রাকৃতিক ভারসাম্য কেঁপে উঠছে।
আমাদের আশেপাশের জীবন প্রকৃতির ঋতুবৈচিত্র্যের ওপর গভীরভাবে নির্ভরশীল। গাছপালার বিকাশ, পশু-পাখির প্রজনন ও অভিবাসন, এমনকি মানুষের উৎসব-পার্বণও নির্ভর করে ঋতুর সুনির্দিষ্ট সময়ে। জাপানে চেরি ফুল ফুটে ওঠে এক নিখুঁত সময়ে, আফ্রিকার প্রাণীরা চলে বিশাল অভিবাসনে, আর গ্রামের মানুষ ফসল কাটার উৎসব পালন করে ঋতুর তালে। এসবই প্রকৃতির এক সুন্দর সুরের প্রতিফলন।
কিন্তু এখন সেই সুরের ভেতরে ঢুকে পড়েছে অজানা ব্যাঘাত। মানুষের তৈরি জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ বিপর্যয় এই ছন্দকে ভেঙে দিচ্ছে। অনেক জায়গায় বর্ষা সময়ের আগেই চলে আসছে, আবার কোথাও তুষার গলছে অসময়ে। বন কাটা, নদীতে বাঁধ দেওয়া, বাতাসে দূষণ—সব মিলিয়ে প্রকৃতির চেনা নিয়মে লেগেছে বড় রকমের ধাক্কা।
এই পরিবর্তনের সরাসরি প্রভাব দেখা যাচ্ছে স্নো খরগোশের মতো প্রাণীতে। শীতে তারা সাদা রঙ ধারণ করে তুষারের সঙ্গে মিশে থাকে শিকারীদের হাত থেকে বাঁচার জন্য। কিন্তু তুষার ঠিক সময়ে না পড়ায় তাদের সেই ছদ্মবেশ কাজে আসছে না, ফলে তারা সহজ শিকারে পরিণত হচ্ছে। এতে শুধু একটি প্রজাতি নয়, ভেঙে পড়ছে পুরো খাদ্য শৃঙ্খল, বিপর্যস্ত হচ্ছে বাস্তুতন্ত্র।
এমন উদাহরণ আরও অনেক। সমুদ্রের প্ল্যাংকটনের সময়চক্র আর মাছের প্রজননকাল সঠিকভাবে মিলছে না। এতে করে মৎস্যশিল্পের ওপর পড়ছে মারাত্মক প্রভাব। এমনকি পর্যটনের মৌসুমি ব্যবসাও আর আগের মতো আয়-রোজগার করতে পারছে না।
সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয়, অনেক প্রজাতিই এত দ্রুত পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারছে না। অভিযোজনের সময় না পেয়ে তারা অস্তিত্ব সংকটে পড়ছে। এতে হারিয়ে যাচ্ছে জীববৈচিত্র্য, যা একবার হারালে আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, ঋতুগতের এই পরিবর্তন কতটা গভীর প্রভাব ফেলছে তা এখনও আমরা পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারিনি। তবে গবেষণা চলেছে। শত বছর আগের সংরক্ষিত বীজ বিশ্লেষণ, পরীক্ষাগারে কৃত্রিমভাবে ঋতু পরিবর্তনের প্রভাব দেখা—এসব আমাদের ভবিষ্যৎ বোঝার চাবিকাঠি হতে পারে।
তবে এখনই সব কিছু শেষ হয়ে যায়নি। এখনও সময় আছে সচেতন হওয়ার। বিজ্ঞান, গবেষণা আর প্রাচীন জ্ঞানের সমন্বয়ে অনেক সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। যেমন আদিবাসীদের আগুন ব্যবস্থাপনা বা আধুনিক কৃষির মৌসুমি কৌশলগুলো আমাদের দেখাচ্ছে, কিভাবে প্রকৃতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে টিকে থাকা যায়।
ঋতুর পরিবর্তন আজ কেবল প্রকৃতির সংকেত নয়, বরং এটি মানব সভ্যতার এক বড় পরীক্ষা। এই সংকটের সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের জিজ্ঞেস করতে হবে—আমরা কি প্রস্তুত? প্রকৃতির হারানো সুর কি আমরা আবার ফিরিয়ে আনতে পারব?
এই প্রশ্নের উত্তর আমাদেরই খুঁজে বের করতে হবে, দায়িত্ব নিয়ে, সচেতনভাবে। কারণ ঋতু বদলাচ্ছে, প্রকৃতির ভাষা পাল্টাচ্ছে। কিন্তু আমরা চাইলে, বিজ্ঞান আর ভালোবাসা দিয়ে আবারও সেই হারানো ছন্দ ফিরিয়ে আনতে পারি।
No comments