ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে চীন ও রাশিয়ার অবস্থান
চীন ও রাশিয়া ইরান-ইসরায়েল চলমান উত্তেজনায় সরাসরি জড়াতে চাইছে না। তবে তারা নিজেদের অবস্থান স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছে।
চীনের অবস্থান
১৩ জুন চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, তারা ইরানের সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা ও ভূখণ্ডের অখণ্ডতা লঙ্ঘনের বিরোধিতা করে।
চীন বলেছে, যারা আঞ্চলিক উত্তেজনা বাড়ায় কিংবা সংঘাত সৃষ্টি করে, তারা সেই কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করে। সব পক্ষকে শান্তি বজায় রাখার আহ্বান জানায় তারা।
এক চীনা মুখপাত্রকে প্রশ্ন করা হয়েছিল—যদি ইরানের ওপর আবার হামলা হয়, তবে হরমুজ প্রণালী বন্ধ করার ইরানি হুমকিকে চীন সমর্থন করবে কি না। জবাবে তিনি বলেন, এমন অনুমানভিত্তিক প্রশ্নের উত্তর দেওয়া ঠিক নয়। তিনি এ-ও বলেন, কেউই চায় না এই অঞ্চলের পরিস্থিতি আরও খারাপ হোক।
চীন তাদের ইসরায়েল ও ইরানে অবস্থিত দূতাবাসে নিরাপত্তা সতর্কতা জারি করেছে এবং চীনা নাগরিকদের সতর্ক থাকতে বলেছে।
এর আগে ২০২৪ সালের অক্টোবরেও চীন একই রকম অবস্থান নিয়েছিল। তখনকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই বলেছিলেন, অব্যাহত যুদ্ধ এ অঞ্চলের কারও জন্যই ভালো নয়।
তিনি ইরান ও ইসরায়েল উভয় পক্ষকে সচেতনভাবে পদক্ষেপ নিতে বলেন, যেন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে না যায়। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচির সঙ্গে বৈঠকেও তিনি বলেন, চীন সামরিক উত্তেজনার বিরোধী এবং সংঘাত এড়াতে চায়।
জাতিসংঘেও চীন ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করেছে। ২০২৪ সালের অক্টোবরেই জাতিসংঘে চীনের প্রতিনিধি ফু কং ইরানে ইসরায়েলি হামলা নিয়ে উদ্বেগ জানান এবং ইসরায়েলকে উসকানিমূলক তৎপরতা বন্ধের আহ্বান জানান।
সবশেষে, ২০২৫ সালের ১২ জুন আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (IAEA)-এর বোর্ড অব গভর্নরস-এর এক ভোটে চীন ও রাশিয়া ইরানের বিপক্ষে আনা প্রস্তাবের বিরোধিতা করে।
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানি প্রস্তাব দিয়েছিল, ইরান তার পারমাণবিক প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘন করছে।
চীনের প্রতিনিধি লি সং বলেন, চাপ, অবরোধ কিংবা শক্তি প্রয়োগে সমস্যার সমাধান হয় না। তিনি বলেন, ২০১৫ সালের পারমাণবিক চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বেরিয়ে আসাই বর্তমান সংকটের মূল কারণ।
চীনা জনমত ও মিডিয়া প্রতিক্রিয়া
চীনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ওয়েইবোতে ইরান-ইসরায়েল সংঘর্ষ ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। একটি হ্যাশট্যাগ ১৬ কোটি বার দেখা হয়েছে, মন্তব্য এসেছে ৭৬ হাজার।
চীনের রাষ্ট্রীয় টিভি চ্যানেল সিসিটিভিও সংঘাতের খবর সরাসরি সম্প্রচার করেছে।
বিখ্যাত চীনা ভাষ্যকার হু শিজিন বলেন, ইরানের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা দুর্বল। তিনি বলেন, ইসরায়েল বিপ্লবী গার্ডসের কমান্ডার হোসেইন সালামি ও পারমাণবিক বিজ্ঞানীদের অবস্থান শনাক্ত করে হত্যা করেছে, যা তিনি ‘সন্ত্রাসী হামলা’ বলে উল্লেখ করেন।
আরেক ভাষ্যকার শেন ই বলেন, ইরানের অভ্যন্তরে হয়তো কেউ ইসরায়েলের সঙ্গে আঁতাত করছে। হু শিজিন আরও বলেন, ইরানের কড়া ভাষার বিপরীতে প্রতিরোধহীনতা এক ধরনের ট্র্যাজেডি।
তিনি মন্তব্য করেন, এটি চীনের জন্যও শিক্ষা—ক্ষমতা ছাড়া অবস্থান কোনো মূল্য বহন করে না।
জিভো শিয়াশি নামে এক জাতীয়তাবাদী ব্লগার লেখেন, ইসরায়েলের এই আচরণ দেখায়—তুমি যতই নম্র হও, শত্রু ক্ষমা করবে না। তার ভাষায়, “জিতে গেলে তুমিই ঠিক। এই দুনিয়ার নিয়মই এমন।”
রাশিয়ার অবস্থান
রাশিয়া সরাসরি কোনো কড়া প্রতিক্রিয়া না দিলেও তাদের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন চ্যানেল ১ ও রাশিয়া চ্যানেল ইসরায়েলের হামলার খবর প্রচার করেছে।
তারা জানিয়েছে, ইসরায়েল শুধু সামরিক নয়, বেসামরিক এলাকাও লক্ষ্যবস্তু করেছে। এসব এলাকায় উচ্চপর্যায়ের ইরানি সামরিক কর্মকর্তারা অবস্থান করছিলেন, এমন দাবি করেছে তারা।
টেলিগ্রামে জাপিসকি ভেটেরান নামের একটি চ্যানেল ব্যঙ্গ করে বোমা হামলার ছবির নিচে লিখেছে—"এইসবই সম্ভবত সেই পারমাণবিক সামরিক স্থাপনা, যেগুলো নিয়ে ইসরায়েল বলছিল।"
ভাষ্যকার ইউরি পডোলিয়াকা বলেন, ইউরোপীয় শক্তিগুলোর কাছ থেকে কোনো গঠনমূলক প্রতিক্রিয়া আসবে বলে মনে হয় না।
রাশিয়ার রাজনৈতিক ভাষ্যকার সার্গেই মার্কভ, যিনি রুশ পার্লামেন্টের সাবেক সদস্য, বলেন, রাশিয়া ইরানের বন্ধু ও রাজনৈতিক মিত্র হলেও সামরিক মিত্র নয়।
তিনি বলেন, রাশিয়ার ভূমিকা হতে পারে ভবিষ্যতে কোনো রাজনৈতিক সমাধানে মধ্যস্থতা করা। আপাতত রাশিয়া পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে।
রাশিয়ার উপস্থাপক আরতিয়ম শেইনিনও বলেন, এখন পরিস্থিতি খুব অনিশ্চিত।
একই সঙ্গে, মার্কিন প্রতিরক্ষা সামগ্রী ইউক্রেন থেকে সরিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে স্থানান্তর নিয়ে সন্দেহ রয়েছে যে, যুক্তরাষ্ট্র হয়তো একসঙ্গে একাধিক ফ্রন্টে খেলা খেলছে।
রাশিয়া-ইরান সামরিক সম্পর্ক
২০২৫ সালের জানুয়ারিতে রাশিয়া ও ইরান একটি বিস্তৃত কৌশলগত অংশীদারত্ব চুক্তি স্বাক্ষর করে।
এই চুক্তিতে সামরিক সহযোগিতার বিষয়ও রয়েছে।
তবে ২০২৫ সালের এপ্রিলে রাশিয়ার উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রেই রুডেনকো বলেন, ইরান যুদ্ধে জড়ালেও রাশিয়া বাধ্যতামূলকভাবে সামরিক সহায়তা দেবে না।
No comments