Header Ads

অন্তর্বর্তী সরকারের ১০ মাসে থমকে আছে আইপিওশূন্য পুঁজিবাজার

 

    

অন্তর্বর্তী সরকারের ১০ মাসে থমকে আছে আইপিওশূন্য পুঁজিবাজার



আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের প্রায় ১০ মাস পেরিয়ে গেলেও দেশের পুঁজিবাজারে একটি নতুন কোম্পানিও প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) অনুমোদন পায়নি। ফলে বাজারে নতুন বিনিয়োগ প্রবাহ বন্ধ হয়ে আছে। বিনিয়োগকারীদের আশা ছিল, নতুন বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) পুঁজিবাজারে গতি ফিরিয়ে আনবে। কিন্তু বাস্তবে হয়েছে তার উল্টো—বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা তৈরি হওয়ার বদলে বেড়েছে অনাস্থা।

এই সময়জুড়ে পুঁজিবাজারে লেনদেন কমে গেছে, সূচকের বড় পতন ঘটেছে এবং তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর ওপর অতিরিক্ত চাপ তৈরি হয়েছে। এর মধ্যেই নতুন কোনো কোম্পানির তালিকাভুক্ত না হওয়া বিনিয়োগকারীদের হতাশ করেছে আরও।

পুঁজিবাজারে পুঁজির জোগান বন্ধ কেন?

বিশ্লেষকরা বলছেন, পুঁজিবাজারের মূল কাজ হলো বিনিয়োগের জন্য পুঁজি জোগানো। নতুন কোম্পানি তালিকাভুক্তির মাধ্যমে তারল্য বাড়ে, বাজারে গতি আসে এবং দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বাড়ে। অথচ অন্তর্বর্তী সরকারের সময়কালে বিএসইসি একটিও নতুন আইপিও অনুমোদন করেনি। বরং ১৭টি আইপিও আবেদন বাতিল করেছে, যা দেশের পুঁজিবাজার ইতিহাসে নজিরবিহীন।

মূলত পাবলিক ইস্যু রুলস ২০১৫ কঠিন হয়ে যাওয়ায় নতুন কোম্পানির পক্ষে আইপিও অনুমোদন পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এই বিধিমালা সহজ করার দাবি উঠেছে।

নতুন কমিশন, পুরোনো সংকট

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর খন্দকার রাশেদ মাকসুদের নেতৃত্বে বিএসইসির নতুন কমিশন দায়িত্ব নেয়। কিন্তু দায়িত্ব নেওয়ার পর ১০ মাসেও কোনো নতুন আইপিও অনুমোদন দেয়নি তারা।

বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামও তার দ্বিতীয় মেয়াদে (২০২3 সালের পর) কোনো আইপিও অনুমোদন দেননি। ফলে টানা দুই কমিশনের সময়ে নতুন আইপিও বন্ধ থাকল।

আগ্রহ থাকলেও সুযোগ নেই

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) একজন পরিচালক জানান, নতুন আইপিও না আসায় বিনিয়োগকারীদের বিকল্প বিনিয়োগের সুযোগ কমে গেছে। এতে বাজারে তারল্য সংকট তৈরি হয়েছে। তিনি বলেন, কোম্পানিগুলো আইপিওর মাধ্যমে মূলধন সংগ্রহ করে ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে পারে। এর ফলে কর্মসংস্থান বাড়ে এবং অর্থনীতিতে গতি আসে।

তবে দীর্ঘ অনিয়মের ইতিহাস, ত্রুটিপূর্ণ মূল্য নির্ধারণ প্রক্রিয়া এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বাজারে আস্থা ফিরছে না। এ ছাড়া বর্তমানে বিদ্যমান আইপিও বিধিমালা অনেক কঠোর, যার কারণে কোম্পানিগুলো আবেদন করতে আগ্রহী হচ্ছে না।

সর্বশেষ আইপিও কবে?

বিএসইসি সর্বশেষ আইপিও অনুমোদন দেয় ২০২৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে। ২০২৪ সালে মাত্র চারটি কোম্পানি—এনআরবি ব্যাংক, বেস্ট হোল্ডিং, এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজ ও টেকনো ড্রাগস—আইপিওর মাধ্যমে ৬৪৫ কোটি টাকা সংগ্রহ করে। এরপর আর কোনো নতুন কোম্পানি আইপিওতে আসেনি।

২০২৩ সালে চারটি কোম্পানি (মিডল্যান্ড ব্যাংক, ট্রাস্ট ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্স, শিকদার ইনস্যুরেন্স, ক্যাপিটেক গ্রামীণ ব্যাংক গ্রোথ ফান্ড) আইপিওর মাধ্যমে মাত্র ২০২ কোটি টাকা সংগ্রহ করে। এর আগে ২০২২ সালে ছয়টি কোম্পানি ৬২৬ কোটি টাকা, ২০২১ সালে ১৫টি কোম্পানি ১,৮৫৮ কোটি টাকা এবং ২০২০ সালে ৮টি কোম্পানি ৯৮৫ কোটি টাকা উত্তোলন করেছিল।

বিনিয়োগকারীদের ব্যাপক সাড়া

যদিও নতুন আইপিও আসছে না, তবে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ কমেনি। টেকনো ড্রাগসের আইপিওতে প্রায় ২,৪০০ কোটি টাকার আবেদন জমা পড়ে, যা বরাদ্দের তুলনায় ২৫ গুণ বেশি। বেস্ট হোল্ডিংসের আইপিওতে ৩৫০ কোটি টাকার শেয়ারের বিপরীতে আবেদন পড়ে ১,৩২১ কোটি টাকার বেশি।

বিএসইসির ব্যাখ্যা

বিএসইসির মুখপাত্র আবুল কালাম বলেন, আইপিও বাতিলের ক্ষেত্রে আইন মেনেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বাতিল হওয়া কোম্পানিগুলো পাবলিক ইস্যু রুলস ২০১৫ মানেনি। তবে তিনি স্বীকার করেন, এই নিয়ম কিছুটা কঠিন। এজন্য একটি টাস্কফোর্স গঠন করে নিয়ম সহজ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, নিয়ম সহজ হলে কোম্পানিগুলো ভালো দামে বাজারে আসতে পারবে এবং বিনিয়োগকারীদের জন্য বাজারে আরও সুযোগ সৃষ্টি হবে।

বাজার সংশ্লিষ্টদের মতামত

মিডওয়ে সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশেকুর রহমান বলেন, নতুন কোম্পানি না আসা পুঁজিবাজারের জন্য খুবই নেতিবাচক। আইপিও হচ্ছে পুঁজিবাজারের মৌলিক কাজ। এই প্রক্রিয়া বন্ধ থাকলে বোঝা যায় বাজার কার্যকরভাবে চলছে না।

তিনি বলেন, আগে অনেক সময় বিএসইসি জোর করে আইপিও অনুমোদন দিত। এখন দরকার স্বচ্ছ ও দায়িত্বশীল প্রক্রিয়া, যাতে ডিএসই প্রাথমিকভাবে মূল্যায়ন করে, আর বিএসইসি তা যাচাই করে অনুমোদন দেয়।

তিনি আরও বলেন, নিরীক্ষক বা ইস্যু ম্যানেজার মিথ্যা তথ্য দিলে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা থাকা উচিত। পাশাপাশি কোম্পানিগুলোর তালিকাভুক্তির জন্য ছয় মাস সময় বেঁধে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি, যাতে তারা এই সময়ের মধ্যে নিজেদের প্রস্তুত করতে পারে।

No comments

Powered by Blogger.