Header Ads

জীবনের সঙ্গে দেশের গল্প: সাংবাদিক আতাউস সামাদের স্মৃতিচারণ

  

জীবনের সঙ্গে দেশের গল্প: সাংবাদিক আতাউস সামাদের স্মৃতিচারণ


  


সাংবাদিক আতাউস সামাদের কর্মজীবন নিয়ে লিখবার মতো অনেক কিছু আছে। তার জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের সৃষ্টি থেকে শুরু করে বিভিন্ন ভাঙাগড়ার ইতিহাস। ১৯৭১-এর পূর্ব থেকেই স্বাধীনতা যুদ্ধ, যুদ্ধ-পরবর্তী রাজনৈতিক আশা-হতাশা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও সরকারের অব্যবস্থার ফলে সৃষ্ট দুর্ভিক্ষ, দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের ওঠাপড়া, বিভিন্ন সময়ের সামরিক ও বেসামরিক নেতৃত্বের অধীনে দেশের অবস্থা — সবকিছুই তিনি পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ ও নথিভুক্ত করে গেছেন।

বিভিন্ন সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করে কীভাবে আবার দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ, তা তিনি প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে ভুক্তভোগী ও সংগ্রামী মানুষের পাশে থেকে লিপিবদ্ধ করে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেছেন। তার এসব কাজ ও লেখা সংকলন করা একটা বড় গবেষণার বিষয়। দেশের প্রকৃত ইতিহাস সংরক্ষণের জন্য তা করা খুবই জরুরি।

আমি আমার বাবা, মানুষ আতাউস সামাদের কথা লিখছি। যাকে সাংবাদিক আতাউস সামাদ থেকে আলাদা করা যায় না। তবে এতে যোগ হয় অনেক কিছুই। যদি কখনো রাজনীতি বা জাতীয় ইতিহাসের গন্ধ কম বা না থাকে, তার কারণ হলো আমি বাবার একটি পূর্ণাঙ্গ ছবি গড়ার চেষ্টা করছি হয়তো এই কথাগুলোয়। যে বাবা ছুটির দিনে সকালে আদর করে আমাদের ঘুম থেকে ওঠাতেন, মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন — এটা ছিল আমার বড় আরামের প্রিয় মুহূর্ত। বড় হয়ে মাঝেমধ্যে আমি নিজেও মাথা এগিয়ে দিয়ে সেই আরাম ও আদর নিতে চাইতাম। কোনোদিন আমি নিরাশ হইনি, ব্যস্ততার মধ্যেও নয়।

তবে ব্যস্ততার মাঝে আব্বা অনেক সময় ভুলে যেতেন আমরা ভাইবোনরা কে কোন ক্লাসে পড়ি। কিন্তু আমরা কী শিখছি, কী বলছি—সেটা ঠিকই খবর রাখতেন। স্কুলে অঙ্কে ডাব্বা মারছি, ইংরেজি রচনা ভালো হয়েছে — সে বিষয়ে প্রতিক্রিয়া দেওয়ার সময় বাবার নজর পড়তো। এটার একটা নিয়ম ছিল—ত্রৈমাসিক, অর্ধবার্ষিক ও বার্ষিক পরীক্ষার সময় বাবার খেয়াল রাখা হতো।

আমি লেখক নই। স্মৃতির পাতায় বাবাকে শব্দে রূপ দেওয়া আমার জন্য সহজ নয়, তার ওপর ভাবাবেগও আছে। তবুও দেশের প্রতি প্রেমিক এই মানুষটির কথা দশের কাছে পৌঁছে দেওয়ার তাগিদ আমার। কেমন ছিলেন বাবা, স্বামী, সন্তান, ভাই, চাচা, মামা, নানা, দাদা, বন্ধু—একজন দেশপ্রেমিক সাংবাদিক হিসেবে তিনি ছিলেন এমনই।

আমার বাবা জীবনের সব জায়গায় ছিলেন আমার মা। ভালোবাসা, স্নেহ, সহনশীলতার এক সুন্দর মেলবন্ধন ছিল তাদের সম্পর্ক। ছোট ছোট সাদামাটা আচরণের পেছনে ছিল অনেক স্নেহ। একে ছাড়া অন্য কেউ ভালোবাসতেন না। মায়ের ডায়াবেটিস বেড়ে যাওয়ার পরও বাবার লেখা শেষ না হলে তিনি অপেক্ষা করতে পারতেন না; লেখার মধ্য থেকে উঠে খাবার টেবিলে মায়ের সঙ্গে বসে কিছুক্ষণ সময় কাটাতেন। খাবারের সময় মা পাশেই থাকতেন বেশির ভাগ সময়। আলাপ হত দিনের বিশেষ বা চাঞ্চল্যকর বিষয়ে, বাবার লেখা কীভাবে হলো এবং কেন হলো তা নিয়ে। মায়ের মনোযোগ না পেলে মা অবসন্ন হয়ে বলতেন, “আমার কথা মন দিয়ে শোনো না!” বাবার লেখার অনেক পাঠক ছিল, কিন্তু সবচেয়ে বড় শ্রোতা-প্রতিক্রিয়া ছিল আমার মা।

বাবা বাইরে ফিরলে প্রায়ই হাতে থাকত বাদামের ঠোঙা বা ইউসুফ বেকারির নাস্তা। মাগরিবের নামাজ শেষে একসঙ্গে চা খাওয়ার প্রস্তুতি হতো। মা ছিলেন লাইব্রেরিয়ান, ঘরে বাবার লেখার জন্য অনেক পত্রিকা ও বই ছিল, যেগুলো মা সুন্দর করে গুছিয়ে রাখতেন। এ বিষয়ে বাবা একটু দুর্বল ছিলেন। তারা একে অপরের পরিপূরক ছিলেন। নব্বইয়ের দশকে বাড়িতে প্রথম এয়ারকন্ডিশনার আসার পর এক মজার সমস্যা দেখা দিয়েছিলো—মা শীতকাতুরে, বাবা গরম—তাই গরমে এক সময় এসি চালাতেন, পরে বন্ধ করতেন, মা কম্বলের নিচে থাকতেন। একজন অন্য ঘরে থাকতোনা, তা মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। বাবার চঞ্চলতায় মা ছিলেন প্রশান্তি। বিধাতার তৈরি জোড়া। ছোটখাটো মান-অভিমানেও ছিল ভালোবাসার প্রকাশ। বাবা সবসময় মাকে পাশে চেয়েছেন। যুক্তি দেখিয়ে মা চাকরি ছেড়ে বাবার পাশে থেকে লেখালেখি, বাড়ির বিশাল বইয়ের সংগ্রহকে লাইব্রেরিতে রূপ দেওয়া—এসব করেছেন মা। একসময় প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের লাইব্রেরি আধুনিকায়নের পর মা চাকরি ছেড়ে বাবার পাশে ছিলেন। মা চাইতেন কিছুটা বৈষয়িকভাবে নিজেকে গুছিয়ে তুলতে, কিন্তু আমি তার প্রতি উদাসীন ছিলাম, যা তাকে ভাবাতো। মা জীবনের মূলমন্ত্র ছিলেন ‘তওয়াক্কুল’ অর্থাৎ খোদার ওপর ভরসা, তাই চিন্তাভাবনা থাকলেও আফসোস কখনো করেননি।

বছরখানেক আগে মায়ের আলমারির পুরোনো কাগজের মাঝে আমি পেয়েছি ইংরেজি নববর্ষ উপলক্ষে বাবার মায়ের কাছে লেখা একটি চিঠি, ১৯৬৫ সালের। সেখানে বাবা মায়ের জন্য যে নিঃশর্ত ভালোবাসা ঢেলে দিয়েছেন, তা এক অনন্য অর্ঘ্য। বাবা-মার মাঝে বিধাতার অসীম দয়া রয়েছে, যাদের জন্য তারা দুজন একে অপরের হয়ে এ পৃথিবীতে এসেছিলেন। তাই আমার স্মৃতিতে দেখি নানা সংকট, শঙ্কা, আনন্দ ও বেদনার মধ্যে একে অপরকে আগলে রাখা, ভালোবাসা, বন্ধুত্ব ও সম্মানের বন্ধন।

এক ভাই, চার বোনের মধ্যে বাবা ১৯৩৭ সালের ১৬ নভেম্বর ময়মনসিংহে জন্মগ্রহণ করেন। আদরের ডাকনাম ছিল খোকন। বাবা ছোট ভাইয়ের থেকে দশ বছর বড়। বোনেরা বাবাকে খুব আদর করতেন, বিশেষ করে বড় বোনেরা। শুনেছি, ছোটবেলায় বোনেরা বাবাকে সাজিয়ে গুছিয়ে আদর করতেন, খেলার পুতুলের মতো। লায়লা ফুপি ছিলেন সবচেয়ে বড় বোন, যিনি স্বামী ও সন্তান রেখে টাইফয়েডে মারা যান বাবা খুব ছোটবেলায়। পরের বড় বোন শিরীন ফুপি ‘বড় ফুপি’ নামে পরিচিত। তিনি খুব সৌখিন মানুষ ছিলেন, বাবাকে সুন্দর কাপড় পরিয়ে সাজাতে ভালোবাসতেন। পাঁচ-ছয় বছর বয়সে বাবার জন্মদিনের ছবি তারই সাজানো। বড় ফুপির স্নেহ বাবার প্রতি আজীবন ছিল।

জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসনামলে দেশের প্রকৃত অবস্থা ও শাসকের দমননীতি ও দুর্নীতির খবর বিবিসিতে রিপোর্ট করায় স্বৈরাচারী শাসকের চোখে পড়েন বাবা। অনেক সময় পালিয়ে বেড়িয়েছেন অবৈধ গ্রেপ্তার এড়াতে। বড় ফুপিও ভাইকে আশ্রয় দিয়ে লুকিয়ে রেখেছিলেন। মেজো ও ছোট ফুপির সঙ্গে বাবার সম্পর্ক ছিল খুব ঘনিষ্ঠ, অনেক সময় পিঠাপিঠি ভাইবোনের মতো।

মেজো ফুপির রান্নার দক্ষতা অসাধারণ ছিল। দেশি-বিদেশি খাবারের শখ ছিল তার, পোলাও-কোরমা থেকে কেক-পেস্ট্রি পর্যন্ত। তিনি প্রায়ই আমাদের কাছে আসতেন মজাদার খাবার নিয়ে। দাদি বেঁচে থাকাকালীন আমরা দাদির বাড়িতে থাকতাম, মেজো ফুপি দাদির পর আমাদের সঙ্গে থাকতেন, ভাইয়ের কাছে এসে আরাম পেতেন। খাবার টেবিলে বসে চলত নানা আলাপ—বর্তমান, অতীত ও ভবিষ্যৎ প্রসঙ্গে।

ছোট ফুপির সঙ্গে বাবার আলাপ-সালাপ আমাদের জন্য ছিল আকর্ষণীয় পর্যবেক্ষণ। দুজনই মনের কথা প্রকাশে পারদর্শী, তাই কোনো কথা মাটিতে পড়তো না। বাগবিতণ্ডার পরও ফুপির ঠোঁটের কোণে দেখা যেত মুচকি হাসি। তারা একে অপরের ভালো খেয়াল রাখতেন। ছোট ভাই ‘কাকু’ ছিলেন পরিবারের সবচেয়ে ছোট ও আদরের। তার সততার জন্য সাংবাদিকতা পড়ে দারুণ ফলাফল করেন। বিদেশে চাকরি নিয়ে যান, শেষ করেছেন বিবিসি বাংলা বিভাগ থেকে অবসর নিয়ে। বাবাও বিবিসিতে কাজ করতেন, কিন্তু ব্যক্তিগত ও কর্মজীবনের মধ্যে পরিষ্কার ব্যবধান রেখেছেন। কাকু লন্ডনে, বাবা ঢাকায়।

বাবার ও তাঁর ভাইবোনদের মধ্যে মতানৈক্য ছিল, যা ছিল পারিবারিক ও রাজনৈতিক। তবুও উষ্ণতা, স্নেহ ও ভালোবাসা সবকিছুকে ছাপিয়ে গেছে, যা শুরু হয়েছিল আমার দাদা-দাদির থেকে। তাদের ভালোবাসার ছোঁয়া আমরাও অনুভব করেছি।

বাইরের ভাই-বোনের ছেলেমেয়েদের জন্য বাবার হৃদয় ছিল উন্মুক্ত। তাদের প্রতি তিনি নিঃশর্ত সম্মান ও ভালোবাসা দেখিয়েছেন। বড়রা ছিল তার বন্ধু, জীবন ও পরিবার নিয়ে আলাপ-পরামর্শ করতেন। মাঝে মাঝে ভাবি, যদি বাবা আরও বেঁচে থাকতেন, হয়তো তাদের জীবন কিছুটা অন্যরকম হতো। জীবনে এমন বন্ধুসুলভ অভিভাবক থাকা বড় আশীর্বাদ।

বড় চাচাকে সবাই ‘ভাই’ বলে ডাকত। তার চার ছেলে মুক্তিযোদ্ধা। বড় ছেলেটি শহীদ লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশফাকুস সামাদ, বীরউত্তম। আমার খুব কষ্ট যে তার কোনো স্মৃতি নেই। মায়ের কাছে শুনেছি, বাবা তাকে খুব ভালোবাসতেন। বাড়ি থেকে গাড়ি নিতে আসলে আমাকে কোলে নিয়ে বলতেন, ‘কবে আমি বড় হব, আর উনি আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাবেন।’ দুষ্টুমি করে ডাকতেন ‘গার্বেজ ডিস্পোজার’, কারণ যাই খেতে দেওয়া হতো আমি খেয়ে যেতাম।

আমাদের পরিবার মুক্তিযুদ্ধে গভীরভাবে যুক্ত ছিল। বড় চাচাকে পাকিস্তানি সৈন্যরা ধরে নিয়ে গিয়ে অত্যাচার করেছিল। দাদিকেও তারা মারেন, কারণ তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের নাম প্রকাশ করেননি। বাবাকেও একবার ধরে নিয়ে গিয়ে বাড়ির দরজার সামনে ছেড়ে দেয়। তখন বাবা ছিলেন পাকিস্তানের ‘দ্য সান’ পত্রিকার বিশেষ প্রতিনিধি, হয়তো এজন্য। বাবার পরিচয়পত্র ব্যবহার করে কারফিউ ও চেকপোস্ট পার হয়ে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের কৌশলগত খবর আদানপ্রদান করতেন, নিজের জীবন বাজি রেখে। আমাদের পরিবারের আরও অনেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন, যার মধ্যে আমার ছোট চাচা ও মামারাও আছেন। আমার ফুপিরাও মুক্তিযুদ্ধে তাদের ভূমিকা রেখেছেন।

No comments

Powered by Blogger.