Header Ads

আশার আলো, নাকি নতুন বিভাজন?

 

   

আশার আলো, নাকি নতুন বিভাজন?


গত ১৩ জুন লন্ডনের ডরচেস্টার হোটেলে একটি বহুল প্রতীক্ষিত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মধ্যে। এই বৈঠকের প্রতি দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষকদের গভীর আগ্রহ ছিল। কারণ, বৈঠকটির সফলতা অনেকাংশেই নির্ধারণ করতে পারে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক গতিপথ। প্রাথমিকভাবে এটি একটি সফল বৈঠক হিসেবে বিবেচিত হলেও, বাস্তবিক ফলাফল নির্ভর করবে ভবিষ্যতের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ও দলগুলোর অংশগ্রহণের ওপর।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশে একধরনের রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হয়েছে। সেই শূন্যতা পূরণের প্রয়োজনীয়তা থেকেই এই বৈঠক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে ড. ইউনূস এবং তারেক রহমান—দুজনই দেশের রাজনীতিতে অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। একদিকে অস্থায়ী সরকারের নেতৃত্বে ড. ইউনূস, অন্যদিকে বিএনপির দ্বিতীয় প্রধান নেতা তারেক রহমান। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ এবং কার্যত রাজনীতির বাইরে, যদিও দলের অভ্যন্তরে তার প্রভাব এখনো বলিষ্ঠ। জানা গেছে, ঈদুল আজহার দিন খালেদা জিয়া বিএনপি নেতাদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময়ের সময় ইউনূস সরকারের সঙ্গে দ্বন্দ্বে না জড়ানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন। সম্ভবত এ পরামর্শই লন্ডন বৈঠকের পথ সুগম করেছে।

বৈঠকের পর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এটিকে দেশের রাজনীতির একটি “টার্নিং পয়েন্ট” বলে উল্লেখ করেন। তিনি মনে করেন, এই সমঝোতা যদি বাস্তবায়ন হয়, তাহলে দেশের রাজনৈতিক অচলাবস্থা কাটিয়ে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথ তৈরি হতে পারে।

বৈঠকের পর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান এবং বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে জানান, আলোচনায় ফলপ্রসূ সমঝোতা হয়েছে এবং সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হলে ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে।

এই খবরে দেশের অনেক বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতা ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। এলডিপি সভাপতি কর্নেল (অব.) অলি আহমদ, জাসদ সভাপতি শরীফ নূরুল আম্বিয়া এবং বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক প্রত্যাশা প্রকাশ করেছেন যে এই সমঝোতা দেশকে স্থিতিশীলতা ও গণতন্ত্রের পথে নিয়ে যাবে। ১২-দলীয় জোট একে একটি “মাইলফলক” বলে আখ্যা দিয়েছে।

তবে এদিকে জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি ভিন্ন সুরে কথা বলছে। তাদের অভিযোগ, প্রধান উপদেষ্টা শুধুমাত্র বিএনপির সঙ্গে আলোচনায় বসে পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করেছেন। জামায়াতের মতে, শুধু এক দলের সঙ্গে আলোচনার পর যৌথ বিবৃতি ও সংবাদ সম্মেলন রাজনৈতিক সংস্কৃতির ব্যত্যয় এবং এতে ড. ইউনূসের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। তাদের মতে, এতে নির্বাচন নিয়ে জনগণের মধ্যে সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে।

এনসিপিও একই ধরনের অভিযোগ এনেছে। তাদের বিবৃতিতে বলা হয়, শুধু তারিখ নির্ধারণে আলোচনা হলেও ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’, ‘জুলাই সনদ’ এবং বিচার-সংস্কারের বিষয়টি উপেক্ষিত হয়েছে। এতে সরকার যে শুধুমাত্র বিএনপিকেই গুরুত্ব দিচ্ছে, তা প্রতীয়মান হয়েছে বলে তারা মন্তব্য করেছে। মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, ‘শুধু বিএনপির সঙ্গে আলোচনায় নির্বাচনের সময়সীমা নির্ধারণ হলে নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়।’

জামায়াত ও এনসিপির এমন প্রতিক্রিয়া দেখে বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করছেন, এ দুটি সংগঠনের মধ্যে একটি সমন্বিত পরিকল্পনা রয়েছে, যার লক্ষ্য অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে বিএনপির দূরত্ব তৈরি করা এবং নিজ নিজ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সফল করা। এর মধ্যে বিএনপিকে অভিযুক্ত করা হচ্ছে আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন চেষ্টার জন্য, যা আদতে জনমনে বিভ্রান্তি ছড়ানোর কৌশল হতে পারে।

ড. ইউনূস-তারেক বৈঠকের সর্বোচ্চ ইতিবাচক ফল অর্জন করতে হলে দেশের সকল রাজনৈতিক শক্তিকে এই আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। শুধুমাত্র একটি দলের সঙ্গে আলোচনা করে নির্বাচন আয়োজনের চেষ্টা করলে তা দীর্ঘমেয়াদে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। আর এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো—ড. ইউনূস নিজেই কতটা এই সমঝোতা বাস্তবায়নে অনড় থাকতে পারবেন?

এখানে উল্লেখযোগ্য যে, কয়েক সপ্তাহ আগেই জাপান সফরে গিয়ে ড. ইউনূস বিএনপিকে লক্ষ্য করে বলেন, “দেশে একটিমাত্র দল ডিসেম্বরে নির্বাচন চায়।” এই মন্তব্যে বিএনপি ক্ষুব্ধ হয়ে মাঠে নামার হুমকি দেয়। পরে ৬ জুন জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, নির্বাচন ২০২৫ সালের এপ্রিলেও হতে পারে।

ড. ইউনূস দেশে ফিরেছেন ১৪ জুন। এখন সবার দৃষ্টি তাঁর বক্তব্য ও পরবর্তী পদক্ষেপের দিকে। তিনি কি জামায়াত ও এনসিপির অসন্তোষ উপেক্ষা করে লন্ডন বৈঠকের ধারাবাহিকতা বজায় রাখবেন, নাকি রাজনৈতিক চাপের মুখে পিছু হটবেন—সেটাই এখন বড় প্রশ্ন।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘শেষ কথা বলে কিছু নেই’—এই কথাটি হয়তো আবারও সত্য প্রমাণিত হতে চলেছে।

No comments

Powered by Blogger.