এবার রেকর্ড রাজস্ব ঘাটতির মুখে এনবিআর
অর্থবছরের শেষ দিকে সাধারণত রাজস্ব আদায়ে গতি বাড়ে। কিন্তু এবার এর ব্যতিক্রম ঘটছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) চলতি অর্থবছরে বড় ধরনের ঘাটতির মুখে পড়ছে। কারণ, রাজস্ব আহরণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্দোলন ও ঈদের টানা ছুটিতে কার্যক্রম প্রায় অচল ছিল। এর ফলে এক মাসেরও বেশি সময় রাজস্ব সংগ্রহ কার্যক্রম ছিল ঢিলেঢালা। তাতে ঘাটতির পরিমাণ রেকর্ড ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের শুরুতে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। পরে অর্থনৈতিক বাস্তবতায় তা কমিয়ে ৪ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকায় আনা হয়। তবুও ১১ মাসে (মে পর্যন্ত) আদায় হয়েছে মাত্র ৩ লাখ ২১ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ মূল লক্ষ্যমাত্রার ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫৯ হাজার কোটি টাকা, আর সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার ঘাটতি ১ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকা। এনবিআর সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, জুন মাসে এই ঘাটতি পূরণ করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
এই ঘাটতির পেছনে কয়েকটি প্রধান কারণ চিহ্নিত করেছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ও অর্থনীতিবিদরা। বছরের শুরু থেকেই রাজস্ব আহরণে নানা প্রতিবন্ধকতা ছিল। এরপর এপ্রিলে এনবিআর কর্মকর্তাদের মধ্যে আন্দোলন শুরু হয়, যা মে মাস পর্যন্ত চলে। ১২ মে গভীর রাতে এনবিআর বিলুপ্তির অধ্যাদেশ জারির পর আন্দোলন আরও তীব্র হয়। অবস্থান ধর্মঘট, কলম বিরতি ও পরবর্তীতে পূর্ণ কর্মবিরতি পালন করেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এরপর ২৫ মে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আশ্বাসে আন্দোলন প্রত্যাহার করা হলেও, ঈদের টানা ১০ দিনের ছুটিতে রাজস্ব কার্যক্রম আবার স্থবির হয়ে পড়ে। সব মিলিয়ে এই সময়টায় রাজস্ব আদায়ে বড় ধস নামে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, শুধু আন্দোলন ও ছুটি নয়, চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিনিয়োগ স্থবিরতা এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের মন্থর গতিও রাজস্ব আহরণে বড় প্রভাব ফেলেছে। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, “বর্তমান পরিস্থিতিতে চলতি অর্থবছরের বিশাল লক্ষ্যমাত্রা অর্জন অসম্ভব। একইভাবে আগামী অর্থবছরের জন্য যেভাবে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হচ্ছে, সেটিও বাস্তবসম্মত নয়।”
এদিকে, এনবিআরের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, চলতি অর্থবছরে এনবিআর ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ঘাটতির মুখে পড়বে। কাস্টমস, ভ্যাট ও আয়কর—এই তিন খাত থেকে গড়ে প্রতি মাসে ৩০-৩২ হাজার কোটি টাকা আদায় হলেও জুনে লক্ষ্যমাত্রা পূরণে প্রয়োজন হবে মাসে প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব, যা এনবিআরের বাস্তব সক্ষমতার বাইরে।
মে মাস পর্যন্ত আদায় করা রাজস্ব খাতভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে—
-
কাস্টমস থেকে আদায় হয়েছে ৯২ হাজার ৪৬১ কোটি টাকা
-
ভ্যাট থেকে আদায় হয়েছে ১ লাখ ২৪ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা
-
আয়কর থেকে আদায় হয়েছে ১ লাখ ৪ হাজার ৪১৩ কোটি টাকা
শুধু মে মাসে তিন খাত মিলে মোট রাজস্ব আদায় হয়েছে ৩২ হাজার ১৮২ কোটি টাকা। এর আগের মাস এপ্রিলেও আদায় হয়েছিল প্রায় ৩০ হাজার ৭৭০ কোটি টাকা। অথচ জুনে লক্ষ্যমাত্রা পূরণে এনবিআরকে তার পাঁচগুণ বেশি আদায় করতে হবে।
অর্থনীতিবিদ মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, “বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত বিশ্বের মধ্যে অন্যতম নিচে। কর ফাঁকি রোধ ও সুশাসন নিশ্চিত না করলে এই ঘাটতির ধারা বন্ধ হবে না।” তার মতে, ঘাটতি কমাতে হলে কর ব্যবস্থায় সংস্কার, রাজস্ব ফাঁকি বন্ধে অডিট কার্যক্রম সক্রিয় করা এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে।
সার্বিকভাবে বলা যায়, এনবিআর এ বছর যে ঘাটতির মুখে পড়েছে, তা শুধুই রাজস্ব আহরণব্যবস্থার দুর্বলতা নয়, বরং এর পেছনে রয়েছে কাঠামোগত সমস্যাসহ রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অস্থিরতা। সেইসঙ্গে, দীর্ঘ সময় ধরে বন্ধ থাকা প্রিভেন্টিভ ও অডিট কার্যক্রম, যা রাজস্ব ফাঁকির বিরুদ্ধে কাজ করে থাকে, সেগুলোর স্থবিরতাও পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
অর্থবছরের শেষ দিকে মাত্র ১৫ দিন হাতে থাকলেও বিশাল ঘাটতি পুষিয়ে ওঠা আর সম্ভব নয় বলেই মত দিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও এনবিআরের কর্মকর্তারা। তাদের মতে, এ অবস্থা থেকে উত্তরণে জরুরি ভিত্তিতে কাঠামোগত সংস্কার ও কার্যকর নেতৃত্ব প্রয়োজন।
No comments