চীনের লক্ষ্য কি বিশ্ব নিয়ন্ত্রণ করা?
চীন এখন শুধু অর্থনৈতিক শক্তি নয়, বরং বিশ্বে সামরিক এবং কৌশলগত দিক থেকেও নিজের আধিপত্য বিস্তারে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। এই আধিপত্য বিস্তারের অংশ হিসেবে চীন আফ্রিকার এক-তৃতীয়াংশ বাণিজ্যিক বন্দরে কাজ করছে।
আফ্রিকায় চীনের প্রভাব বিস্তার
আফ্রিকা সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ-এর তথ্য অনুযায়ী, চীন ৩২টি আফ্রিকান দেশের ৭৮টি বন্দরের উন্নয়ন, অর্থায়ন ও পরিচালনায় জড়িত।
-
পূর্ব আফ্রিকায় ৩৫টি বন্দর
-
দক্ষিণ আফ্রিকায় ১৫টি
-
উত্তর আফ্রিকায় ১১টি বন্দর
এই সব মিলিয়ে আফ্রিকার মোট ২৩১টি বাণিজ্যিক বন্দরের এক-তৃতীয়াংশের বেশি চীনের প্রভাবাধীন। চীনা বন্দর উন্নয়নের অনেক জায়গায় সরাসরি নৌবাহিনীর উপস্থিতিও রয়েছে।
আফ্রিকার বাইরেও বিস্তার
আফ্রিকা ছাড়াও এশিয়া, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে বন্দর নিয়ন্ত্রণের জন্য চীন সক্রিয়।
২০১৭ সালে চীন আফ্রিকার জিবুতিতে প্রথম বিদেশি নৌঘাঁটি স্থাপন করে। তখন চীন দাবি করেছিল, এটি শান্তিরক্ষা ও মানবিক সহায়তার জন্য। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি বিশ্ব রাজনীতিতে চীনের উচ্চাকাঙ্ক্ষার স্পষ্ট উদাহরণ।
বিশ্বব্যাপী চীনের নৌঘাঁটি গঠনের পরিকল্পনা
বিশেষজ্ঞদের মতে, চীন আগামী কয়েক বছরে আটটি বিদেশি নৌঘাঁটি স্থাপনের পরিকল্পনা করছে।
-
২০০০ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত চীন বিশ্বের ৪৬টি দেশে ৭৮টি বন্দরে ১২৩টি প্রকল্পে বিনিয়োগ করেছে।
-
এসব প্রকল্পে মোট ব্যয় হয়েছে প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলার।
-
২০০০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে এসব বন্দরের অবকাঠামো নির্মাণ শেষ হয়েছে।
চীনের নিজস্ব আইনের অধীনে এসব বেসামরিক বন্দর প্রয়োজনের সময় চীনা নৌবাহিনীকে সহায়তা দিতে বাধ্য। অর্থাৎ, যে বন্দর চীন বানায়, সেটা সামরিকভাবে ব্যবহার করার অধিকার চীন রাখে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরোধ ও চীনের প্রতিকৌশল
এইডডাটা নামক মার্কিন গবেষণা সংস্থা বলছে, চীন যে আটটি জায়গায় নৌঘাঁটি গড়তে পারে, তার মধ্যে বেশিরভাগ ইন্দো-প্যাসিফিক এলাকায়। এতে বোঝা যায়, চীনের মূল লক্ষ্য মার্কিন উপস্থিতিকে হ্রাস করা।
বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত এবং কোয়াড জোটের চাপে ভারত মহাসাগর অঞ্চলে চীন সক্রিয়ভাবে প্রতিরোধ গড়তে চায়।
আফ্রিকায় বন্দর নির্মাণে চীনের কৌশলগত আগ্রহ
মৌরিতানিয়া থেকে শুরু করে গিনি উপসাগর হয়ে ক্যামেরুন, অ্যাঙ্গোলা ও গ্যাবনের মতো দেশগুলিতে বন্দর নির্মাণ করছে চীন। এই অঞ্চলগুলোতে চীনা কার্যক্রম বেড়েই চলেছে।
বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে চীনের প্রধান বন্দর ও সামরিক আগ্রহ
-
চাঙ্কাই, পেরু
লাতিন আমেরিকার পেরুর উপকূলে চীনের বিশাল চাঙ্কাই বন্দর উদ্বোধন করেছেন প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। ২০২৪ সালের নভেম্বরে এটি চালু হয়। এই বন্দর লাতিন আমেরিকা ও এশিয়ার মধ্যে বাণিজ্যকে আরও সুগম করবে। -
বাটা, ইকুয়েটোরিয়াল গিনি
চীনা নৌঘাঁটি গড়ে তোলার সম্ভাবনায় মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগ উদ্বিগ্ন। এটি চীনের জন্য কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি পশ্চিম আটলান্টিকে সামরিক কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ দেয়। -
ক্রিবি, ক্যামেরুন
চীনের বিশাল বিনিয়োগে গড়া এই বন্দর থেকে মধ্য আটলান্টিকে চীনের বাণিজ্যিক ও সামরিক প্রভাব বাড়ছে। -
রেম, কম্বোডিয়া
কম্বোডিয়ার রেম বন্দর চীনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি ভারত মহাসাগর থেকে দক্ষিণ চীন সাগরে প্রবেশের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট। -
লুগানভিল, ভানুয়াতু
প্রশান্ত মহাসাগরের ছোট্ট দ্বীপ ভানুয়াতুর এই বন্দরটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মার্কিন নৌঘাঁটি ছিল। এখন চীন এখানে সামরিক ঘাঁটি গড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন গবেষকরা। -
নাকালা, মোজাম্বিক
যদিও বিনিয়োগ কম, তবে জনগণের মধ্যে চীনের জনপ্রিয়তা এবং কৌশলগত অবস্থান বিবেচনায় বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ভবিষ্যতে এখানে চীনা নৌঘাঁটি হতে পারে। -
নোয়াকচট, মৌরিতানিয়া
ইউরোপ ও জিব্রাল্টার প্রণালীর নিকটে হওয়ায় এই জায়গাটি চীনের জন্য কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। -
ওয়াইল্ড কার্ড: রাশিয়া
বিশেষজ্ঞদের মতে, চীন ভবিষ্যতে উন্নত বিশ্বেও সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের চেষ্টা করতে পারে। সে ক্ষেত্রে রাশিয়ার সহযোগিতায় চীন রুশ নৌঘাঁটিগুলো যৌথভাবে ব্যবহার করতে পারে।
চীনের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য কী?
বিশ্লেষকদের মতে, চীন বিশ্বের সমুদ্রপথ ও কৌশলগত chokepoints নিয়ন্ত্রণে নিতে চায়। এর মাধ্যমে তারা মার্কিন নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করতে চায়।
চীন যেমন অর্থনৈতিক উন্নয়ন দেখাচ্ছে, তেমনি সামরিক প্রস্তুতিও নিচ্ছে। বন্দরের মাধ্যমে চীন আসলে সামরিক উপস্থিতি এবং কৌশলগত নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে চাইছে।
বিশ্ব রাজনীতির অদূর ভবিষ্যতে চীন কীভাবে এই বন্দরগুলোকে ব্যবহার করে — তা নজরদারির বিষয়। তবে এতটুকু পরিষ্কার, চীন বিশ্বনিয়ন্ত্রণের খেলায় অনেক দূর এগিয়ে গেছে।
No comments