বিএনপির নির্বাচনী প্রস্তুতি: কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্ভাবনা ও কৌশল
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি তাদের রাজনৈতিক কৌশল পুনর্গঠন করছে। দলের নীতিনির্ধারকেরা মনে করছেন, আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক মাঠে দৃশ্যমান না থাকলেও নির্বাচন সহজ হবে না। কারণ, দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নতুন শক্তিগুলোর আবির্ভাব ঘটেছে। একদিকে, বিএনপির একসময়ের জোটসঙ্গী জামায়াতে ইসলামী নতুনভাবে রাজনৈতিক ময়দানে সক্রিয় হয়েছে। অন্যদিকে, গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীদের একটি অংশ নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেছে। ফলে, বিএনপিকে কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হতে হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিএনপির বর্ধিত সভা: রাজনৈতিক কৌশলের ভিত্তি
সম্প্রতি জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হল-সংলগ্ন মাঠে বিএনপির এক বর্ধিত সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় তৃণমূল নেতাদের সতর্ক থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয় এবং নির্বাচনের প্রস্তুতির বিষয়ে দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়। দলীয় সূত্র বলছে, এই সভার মাধ্যমে মূলত তিনটি প্রধান বার্তা তৃণমূলে পৌঁছানো হয়েছে—
- দলীয় ঐক্য ধরে রাখা: দলীয় কর্মীদের মধ্যে বিভেদ দূর করে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে যেতে হবে।
- সামাজিক অপরাধ এড়িয়ে চলা: নেতা-কর্মীদের দখলদারিত্ব, চাঁদাবাজি, সহিংসতা বা অন্য কোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে যুক্ত না থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
- সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিষয়ে সতর্ক থাকা: নির্বাচনে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলগুলোর কার্যক্রম সম্পর্কে সচেতন থাকতে বলা হয়েছে।
তারেক রহমানের নির্দেশনা
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ভার্চ্যুয়ালি সভায় যুক্ত হয়ে নেতা-কর্মীদের দলীয় ঐক্য বজায় রাখার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, “আপনাদের নেতা হিসেবে আমার নির্দেশনা হলো—আজকের সভা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর এবং নিজ নিজ এলাকায় ফিরে যাওয়ার পর আপনাদের উদ্যোগ নিতে হবে। আপনাকে এমন কিছু করতে হবে, যাতে দল ঐক্যবদ্ধ থাকে, খারাপকে দূরে সরিয়ে রাখা যায় এবং জনগণের আস্থা অর্জন করা যায়।”
বিএনপির কৌশলগত পরিবর্তন ও চ্যালেঞ্জ
বর্ধিত সভায় বিএনপির শীর্ষ নেতারা স্বীকার করেছেন যে, গত ১৫-১৬ বছরে আওয়ামী লীগের দমন-পীড়নের কারণে বিএনপি সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছিল। তবে, ৫ আগস্টের পর থেকে দলীয় তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দীন চৌধুরী (এ্যানি) বলেন, “আমরা ঐক্যটাকেই বড় করে দেখছি। বিগত সময়ে সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করা কঠিন ছিল, কিন্তু এখন আমরা পূর্ণ শক্তি নিয়ে ফিরে আসার চেষ্টা করছি।”
এছাড়া, বিএনপির নেতারা মনে করছেন, নির্বাচন সামনে রেখে সরকার পক্ষ থেকে যেকোনো ষড়যন্ত্র হতে পারে। বিশেষ করে, অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে দলটি সন্দিহান। ছাত্র-তরুণদের নতুন দল ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’ গঠন হওয়ায় বিএনপি সতর্ক রয়েছে। কারণ, এর কিছু সদস্য অন্তর্বর্তী সরকারেও গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন। ফলে, নির্বাচন প্রক্রিয়ায় পক্ষপাতিত্ব দেখা গেলে তা বিএনপির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
তৃণমূল নেতাদের মতামত ও দিকনির্দেশনা
বর্ধিত সভায় বিএনপির ১০৬ জন নেতা বক্তব্য দেন। তবে, উপস্থিত নেতাদের মতে, সময় স্বল্পতার কারণে কার্যকর মতামত নেওয়া সম্ভব হয়নি। বেশিরভাগ তৃণমূল নেতা শীর্ষ নেতৃত্বের মনোযোগ আকর্ষণে ব্যস্ত ছিলেন, ফলে নির্বাচন কৌশল, অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিরসন এবং রাজনৈতিকভাবে প্রতিপক্ষকে মোকাবিলার স্পষ্ট রূপরেখা উঠে আসেনি।
বিএনপির রোডম্যাপ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য জহিরউদ্দিন স্বপন বর্ধিত সভা প্রসঙ্গে বলেন, “জাতি ফ্যাসিবাদের ফয়সালা করেছে রাজপথে। নির্বাচিত সরকার গঠিত হবে জাতীয় নির্বাচনে। আর সংস্কারের চলমান প্রক্রিয়া সচল হবে সংসদে। এই হলো বিএনপির রোডম্যাপ।”
তিনি আরও জানান, তারেক রহমানের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্য গঠিত হয়েছে এবং তা নির্বাচন পর্যন্ত টিকিয়ে রাখার পরিকল্পনা রয়েছে।
বিএনপি এখন কঠিন রাজনৈতিক বাস্তবতার মুখোমুখি। একদিকে দলীয় ঐক্য বজায় রাখা, অন্যদিকে নতুন প্রতিপক্ষের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা—এই দুই চ্যালেঞ্জ তাদের মোকাবিলা করতে হবে। বর্ধিত সভার মাধ্যমে দলীয় কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ থাকার নির্দেশনা দেওয়া হলেও, এখনো নির্বাচনী কৌশল পুরোপুরি নির্ধারিত হয়নি। আগামী দিনগুলোতে বিএনপি কীভাবে তাদের রোডম্যাপ বাস্তবায়ন করবে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
No comments