পোড়াদহ মেলায় ১৫ কেজির মাছ মিষ্টি, মূল্য ৯ হাজার টাকা
![]() |
মাছ |
প্রায় ৪০০ বছরের ঐতিহ্য ধারণ করা পোড়াদহ মেলা বগুড়ার গাবতলী উপজেলার ইছামতি নদীর তীরে প্রতি বছর আয়োজিত হয়। এই মেলা মূলত বিশাল আকৃতির মাছের জন্য প্রসিদ্ধ হলেও, এখানে পাওয়া যায় নানান ধরনের বাহারি মিষ্টান্ন। বিশেষ করে মাছের আদলে তৈরি ‘মাছ মিষ্টি’ মেলার অন্যতম প্রধান আকর্ষণ।
মেলা উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ এখানে ভিড় করে, বিশেষ করে নতুন জামাইদের জন্য এ মেলা হয়ে ওঠে স্মরণীয়। এখানে আসা জামাইরা শ্বশুরবাড়ির কাছ থেকে পাওয়া সেলামির টাকা কিংবা নিজেদের জমানো অর্থ দিয়ে মাছ ও মিষ্টি কেনেন। মেলায় নানা ধরনের মাছের সঙ্গে সঙ্গে তৈরি হয় বিভিন্ন মিষ্টান্ন, যার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হচ্ছে ‘মাছ মিষ্টি’। মাছের আদলে তৈরি এই মিষ্টি শুধু আকৃতিতেই ব্যতিক্রম নয়, স্বাদেও অনন্য।
এবারের মেলায় সবচেয়ে বড় ‘মাছ মিষ্টি’ ছিল ১৫ কেজি ওজনের, যার দাম ধরা হয়েছে ৯ হাজার টাকা। বুধবার (১২ ফেব্রুয়ারি) সকালে মেলায় আল-আমিন মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে এই মিষ্টির দেখা মেলে। দোকানি জানান, এই বিশেষ মিষ্টি তৈরি করতে লাগে কয়েক ঘণ্টা এবং এর প্রস্তুতিতে ব্যবহার করা হয় উন্নত মানের ছানা, চিনি ও খোয়া ক্ষীর।
এছাড়াও মেলায় নতুন জামাইদের কেনাকাটার উচ্ছ্বাস ছিল চোখে পড়ার মতো। বগুড়ার তরনীর হাট থেকে আসা নতুন জামাই সুহাইব তালুকদার জানান, তিনি সদ্য বিবাহিত এবং জামাই হিসেবে প্রথমবারের মতো এ মেলায় এসেছেন। তিনি ১৩.৫ কেজি ওজনের একটি কাতল মাছ ১১ হাজার টাকায় কেনেন, পাশাপাশি ৫ কেজি ওজনের একটি ‘মাছ’ মিষ্টি কেনেন ১,৪০০ টাকায়। শ্বশুরবাড়িতে নিয়ে গিয়ে সেই মাছ রান্না হবে, আর মাছ মিষ্টির স্বাদ উপভোগ করবেন পরিবারের সবাই।
মেলায় অংশ নেওয়া মিষ্টি ব্যবসায়ীরা জানান, তারা বছরের পর বছর এই মেলায় আসেন এবং বিভিন্ন রকমারি ডিজাইনের মিষ্টান্ন নিয়ে আসেন। মাছ মিষ্টির পাশাপাশি মেলায় পাওয়া যায় লাভ মিষ্টি, কদম মিষ্টি, চমচম, কালোজাম, স্পঞ্জ মিষ্টি, ছানার জিলাপি, জিলাপি, লাড্ডু, মুড়িমুড়কি, কদমাসহ নানা ধরনের মিষ্টান্ন সামগ্রী। দামও বেশ সাশ্রয়ী—বড় আকারের মিষ্টি ২৫০ টাকা কেজি, মাঝারি আকারের সাদা ও কালো মিষ্টি ১৮০ টাকা কেজি, ছোট আকারের মিষ্টি ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা কেজি, ছানার জিলাপি ২০০-২৪০ টাকা কেজি, পাতা মিষ্টি ২০০-২২০ টাকা কেজি, কদম ২০০-২২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়।
তবে মেলায় শুধুমাত্র মাছ বা মিষ্টির স্টলই নয়, এখানে পাওয়া যায় নানা ধরনের কসমেটিকস, খেলনা, গিফট সামগ্রী, চুড়ি, কানের দুল, মালা, কাজল, মেকআপ বক্স, ব্যাট-বল, ভিডিও গেমসসহ নানা ধরনের প্রসাধনী ও খেলনা সামগ্রী। এছাড়াও মেলায় কাঠ, স্টিল ও লোহার তৈরি বিভিন্ন আসবাবপত্রের দোকানও রয়েছে, যেখানে ক্রেতাদের ভিড় লেগেই থাকে। এছাড়া বাঁশের তৈরি সামগ্রীও পাওয়া যায় এখানে, যা স্থানীয় কারিগরদের দক্ষতার প্রতিচ্ছবি।
একটি উৎসব, একটি ঐতিহ্য
পোড়াদহ মেলা শুধুমাত্র একটি কেনাবেচার স্থান নয়, এটি এক মহামিলনের ক্ষেত্র, যেখানে সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও উৎসবের রঙ একসঙ্গে মিশে যায়। বছরের পর বছর ধরে এই মেলা গ্রামীণ জনপদের মানুষদের জন্য আনন্দের উপলক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নতুন জামাইরা এখানে আসেন, শ্বশুরবাড়ি থেকে পেয়ে যান সেলামি, আর সেই টাকা দিয়ে চলে জম্পেশ কেনাকাটা। মিষ্টির ঘ্রাণ, মাছের হাঁকডাক, দোকানিদের ডাকাডাকি, মানুষের কোলাহল—সবকিছু মিলিয়ে এক অন্যরকম প্রাণবন্ত পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
এই মেলার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো এর ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সংমিশ্রণ। শত শত বছর ধরে পোড়াদহ মেলা গ্রামীণ বাংলার সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে আছে, যা কেবল ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য নয়, বরং মানুষকে একত্রিত করার জন্যও বিশেষ ভূমিকা রাখে। স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, এ মেলা শুধু কেনাকাটার জায়গা নয়, বরং এটি এক মিলনমেলা, যেখানে আত্মীয়-স্বজনেরা একত্রিত হন, নতুন সম্পর্ক গড়ে ওঠে, আর পুরনো বন্ধন আরও দৃঢ় হয়।
এ মেলায় আসা মানুষদের জন্য এটি শুধু একটি বাণিজ্যিক আয়োজন নয়, বরং এটি এক ধরনের উৎসব যেখানে মাছ, মিষ্টি, কেনাকাটা আর আনন্দ মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।
No comments