এক পরিবার ১০ শতাংশের বেশি শেয়ার রাখতে পারবে না: বিমা আইন সংশোধনের উদ্যোগ
বিমা খাতে শৃঙ্খলা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে বিদ্যমান আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। এর অংশ হিসেবে সংশোধন করা হচ্ছে ‘বীমা আইন’ এবং ‘বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ আইন’। সংশোধিত আইনের খসড়া তৈরি করা হয়েছে এবং এ নিয়ে মতামত চাওয়া হচ্ছে সংশ্লিষ্ট অংশীজন, বিশেষজ্ঞ এবং সাধারণ জনগণের কাছ থেকে।
আইডিআরএ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, এসব সংশোধনের মূল উদ্দেশ্য হলো বীমা খাতের উন্নয়ন, গ্রাহকদের স্বার্থ রক্ষা এবং আইনের আধুনিকায়ন। বিশেষ করে আইডিআরএ আইন হালনাগাদ করে কর্তৃপক্ষের ক্ষমতা বাড়ানো এবং খাতটির বিভিন্ন অস্পষ্টতা ও দুর্বলতা দূর করার লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে।
আইডিআরএর চেয়ারম্যান এম আসলাম আলম বলেন, “২০১০ সালে দুটি আইন কার্যকর হওয়ার পর অনেক সময় পেরিয়ে গেছে। এখন সময় এসেছে কিছু বিষয় হালনাগাদ করার। বর্তমান আইনে আইডিআরএ কোনো বীমা কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিতে পারে না। আইন সংশোধিত হলে সেটাও সম্ভব হবে।”
মূল প্রস্তাবনা ও পরিবর্তনগুলো:
১. মালিকানা নিয়ন্ত্রণ:
সংশোধিত বীমা আইনে প্রস্তাব করা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি, কোম্পানি বা একই পরিবারের সদস্যদের মধ্যে কোনো বীমা কোম্পানির মালিকানা কেন্দ্রীভূত রাখা যাবে না। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ১০ শতাংশের বেশি শেয়ার এককভাবে বা যৌথভাবে রাখা যাবে না।
২. তদারকি ও ক্ষমতা:
আইডিআরএ এখন থেকে বীমা কোম্পানির সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম নিয়মিতভাবে পর্যালোচনা করতে পারবে। প্রয়োজন হলে কোনো কোম্পানির অফিসে তল্লাশি চালাতে পারবে এবং দাবি নিষ্পত্তির জন্য কোম্পানির সম্পত্তি বিক্রির ক্ষমতাও পাবে।
৩. পর্ষদ পুনর্গঠন:
কোনো বীমা কোম্পানি বা তার সহায়ক প্রতিষ্ঠান গ্রাহকের স্বার্থ ক্ষুণ্ন করলে আইডিআরএ সেই কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়ে দুই বছরের মধ্যে নতুন করে পর্ষদ গঠন করতে পারবে।
৪. পরিবার সংজ্ঞায় পরিবর্তন:
বর্তমানে ‘পরিবার’ বলতে স্বামী বা স্ত্রী, পিতা-মাতা, পুত্র-কন্যা, ভাই-বোন এবং নির্ভরশীলদের বোঝানো হয়। নতুন প্রস্তাবে জামাতা ও পুত্রবধূকে যুক্ত করা হয়েছে। ‘নির্ভরশীল’ শব্দটি বাদ দেওয়া হয়েছে।
৫. বেআইনি ব্যবসা ও নাম পরিবর্তন:
কোনো কোম্পানি আইনের বিরুদ্ধে গেলে বা আইডিআরএর নির্দেশ অমান্য করলে তা দৈনিক পত্রিকায় ঘোষণা দিয়ে প্রকাশ করতে পারবে কর্তৃপক্ষ। তবে আগে কোম্পানিকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হবে। কোম্পানির নাম পরিবর্তনের জন্য আইডিআরএর অনুমতি নিতে হবে।
৬. কমিশন কাঠামো পরিবর্তন:
জীবনবিমা এজেন্টদের প্রথম বছরের প্রিমিয়ামে কমিশন ৩৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। দ্বিতীয় বছরে কমিশন বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হবে (আগে ১০%), আর পরবর্তী বছরগুলোয় কমিশন ৫ শতাংশ হারে অপরিবর্তিত থাকবে।
৭. শাস্তি ও জরিমানা:
আইনে শাস্তির পরিমাণও বাড়ানোর প্রস্তাব রয়েছে। মূলধন সংরক্ষণে ব্যর্থ হলে কোম্পানি নতুন পলিসি বিক্রি বা প্রিমিয়াম নেওয়া বন্ধ করতে পারবে আইডিআরএ। এ ক্ষেত্রে ১০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা জরিমানা এবং প্রতিদিনের ভিত্তিতে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত অতিরিক্ত জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে।
বর্তমানে সর্বনিম্ন জরিমানা ৫ লাখ টাকা। খসড়া আইনে সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড বা আর্থিক জরিমানাসহ উভয় শাস্তির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
৮. পরিচালকের যোগ্যতা ও মেয়াদ:
কোনো পরিচালক বা শেয়ারহোল্ডার কিংবা তাঁদের পরিবারের সদস্যরা বীমা কোম্পানির সম্পত্তি বন্ধক রেখে ঋণ নিতে পারবেন না। কোনো ব্যক্তি কমপক্ষে ১০ বছরের ব্যবস্থাপনা, ব্যবসায়িক বা পেশাগত অভিজ্ঞতা না থাকলে তিনি বীমা কোম্পানির চেয়ারম্যান বা পরিচালক হতে পারবেন না। পরিচালক পদে টানা মেয়াদ সর্বোচ্চ ৬ বছর পর্যন্ত সীমিত রাখা হয়েছে।
খাতের প্রতিক্রিয়া:
বাংলাদেশ ইনস্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইএ) সভাপতি সাঈদ আহমেদ এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, “আমরা বিআইএর সদস্যদের কাছে মতামত চেয়েছি। সব মতামত নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে আইডিআরএকে জানাব। আমরাও চাই বীমা খাতের উন্নয়ন হোক এবং সে জন্য আইন যুগোপযোগী করা হোক।”
বর্তমান বাস্তবতা:
আইডিআরএর তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ৮২টি বীমা কোম্পানি রয়েছে—এর মধ্যে ৩৬টি জীবন বীমা এবং ৪৬টি সাধারণ বীমা। গত ১৪ বছরে ২৬ লাখের বেশি বীমা পলিসি বাতিল হয়েছে। ২০২৪ সালে বীমা দাবির নিষ্পত্তির হার ছিল মাত্র ৫৭ শতাংশ, যেখানে ১৬ হাজার ৪৮৪ কোটি টাকার দাবির বিপরীতে পরিশোধ করা হয়েছে ৯ হাজার ৪৭৬ কোটি টাকা।
আইডিআরএর এই আইন সংশোধনের উদ্যোগ দীর্ঘদিনের চাহিদার প্রতিফলন। এতে একদিকে গ্রাহকদের স্বার্থ রক্ষা পাবে, অন্যদিকে নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার ক্ষমতা ও কার্যকারিতা বাড়বে। সংশোধিত আইনের মাধ্যমে বীমা খাতের স্বচ্ছতা, জবাবদিহি এবং আস্থার পরিবেশ গড়ে ওঠার আশা করা হচ্ছে।
No comments