শারীরিক প্রতিবন্ধকতা জয় করে প্রশাসন ক্যাডারে উল্লাস পাল
কথায় আছে, স্বপ্নবাজদের দমিয়ে রাখা যায় না। কারণ স্বপ্নই তাদের জীবনের প্রেরণা। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, পৃথিবীর অধিকাংশ সফল মানুষই নানা বাধা-বিপত্তির মধ্য দিয়ে গেছেন। কিন্তু তারা হাল ছাড়েননি বলেই আজ তারা অনুকরণীয়। এমনি এক স্বপ্নবাজ তরুণ হলেন শরীয়তপুরের উল্লাস পাল।
জন্ম থেকেই শারীরিক প্রতিবন্ধকতা ছিল তার। কিন্তু প্রতিকূলতাই তাকে থামিয়ে রাখতে পারেনি। পরিবারে সাপোর্ট আর নিজের কঠোর পরিশ্রম তাকে সাফল্যের শিখরে পৌঁছে দিয়েছে। তিনি ৪৩তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হওয়ার পর ৪৪তম বিসিএসে তার স্বপ্নের প্রশাসন ক্যাডারেও সফলভাবে উত্তীর্ণ হয়েছেন।
উল্লাস পালের বাড়ি শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার রামভদ্রপুর ইউনিয়নের কার্তিকপুর এলাকায়। বাবা উত্তম কুমার পাল একজন মৃৎশিল্পী এবং মা আন্না রানী পাল একজন গৃহিণী। তিন সন্তানের মধ্যে উল্লাস বড়। জন্মগতভাবে তার দুই হাত ও দুই পা বাঁকা ছিল, যার কারণে ছোটবেলায় স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারতেন না। পরিবারের সহযোগিতায় তিনি হাঁটা শুরু করেন। পরে চিকিৎসার জন্য ভারতে নেওয়া হলে তার ডান পায়ে অস্ত্রোপচার হয়, তারপর ধীরে ধীরে নিজের পায়ে হাঁটতে শুরু করেন। যদিও হাঁটাচলা পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি।
উল্লাস ছোটবেলা থেকেই মেধাবী ছিলেন। ১৯৯৯ সালে তিনি ভর্তি হন কার্তিকপুর পালপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। বর্ষার দিনে স্কুলে যেতে কষ্ট হতো বলে বাবা তাকে স্কুলে পৌঁছে দিতেন। তিনি বাম হাতে লিখতেন এবং ফুটবল খেলা খুব পছন্দ করলেও খেলায় অংশ নিতে পারতেন না।
২০১০ সালে তিনি কার্তিকপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হন। এরপর ঢাকায় যান উচ্চ শিক্ষার জন্য। তার ইচ্ছা ছিল ঢাকা কলেজে পড়ার, কিন্তু শারীরিক প্রতিবন্ধকতার কারণে সেখানে সুযোগ পাননি। পরে ঢাকা নর্দান কলেজ থেকে ২০১২ সালে এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হন।
এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ব্যবস্থাপনা বিভাগে ভর্তি হন। সেখান থেকে ২০১৬ সালে বিবিএ ও পরবর্তীতে এমবিএ সম্পন্ন করেন। এরপর শুরু হয় চাকরির প্রস্তুতি। বিভিন্ন পরীক্ষায় অংশগ্রহণের পাশাপাশি বিসিএসেও অংশ নেন তিনি। ৪০তম বিসিএসে পাস করলেও কোনো পদে সুপারিশ পাননি। ৪১তম বিসিএসে জুনিয়র ইন্সট্রাক্টর পদে সুপারিশপ্রাপ্ত হন।
তবে তার স্বপ্ন ছিল বিসিএস ক্যাডারে যাওয়ার। সেই লক্ষ্যেই চলতে থাকে তার চেষ্টা। ৪৩তম বিসিএসে তিনি শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়ে নড়িয়া সরকারি কলেজে প্রভাষক পদে যোগ দেন। কিন্তু তাতেও সন্তুষ্ট হতে পারেননি। তার লক্ষ্য ছিল প্রশাসন ক্যাডার। অবশেষে ৪৪তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হন।
উল্লাস বলেন, “রেজাল্টের দিন যখন আমি আমার রেজিস্ট্রেশন নম্বর প্রশাসন ক্যাডারে দেখি, তখন আনন্দে চোখে পানি চলে আসে। পরিবারও খুব খুশি হয়েছিল। অনেকেই আমাকে শারীরিক প্রতিবন্ধকতার কারণে উপহাস করেছিল, আবার অনেকেই ভালোবাসা দিয়েছে। তবে আমি হাল ছাড়িনি। লক্ষ্য ঠিক রেখে এগিয়ে গেছি।”
তিনি আরও বলেন, “প্রথমে শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশ পেলেও প্রশাসন ক্যাডার ছিল আমার স্বপ্ন। আমি থেমে থাকিনি। আজ সেই স্বপ্ন সফল হয়েছে। আমি চাই, সরকার আমাকে যেখানে দায়িত্ব দেবে, আমি যেন নিষ্ঠার সঙ্গে তা পালন করতে পারি।”
শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী মানুষদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, “সমাজ চাইলেই তাদের জন্য সহানুভূতিশীল পরিবেশ তৈরি করতে পারে। আমি চাই, কেউ যেন প্রতিবন্ধীদের ছোট করে না দেখে।”
তার মা আন্না রানী পাল বলেন, “ছোটবেলা থেকে উল্লাস অনেক সংগ্রাম করেছে। পড়াশোনায় সে খুব মনোযোগী ছিল। আজ সে প্রশাসন ক্যাডারে উত্তীর্ণ হয়েছে—আমরা অনেক গর্বিত।”
বাবা উত্তম কুমার পাল বলেন, “ছেলেকে বিশেষ যত্নে বড় করেছি। তার আগ্রহ আর অধ্যবসায়ের ফলেই সে আজ এই অবস্থানে পৌঁছেছে।”
প্রতিবেশী রূপক পাল বলেন, “উল্লাস প্রমাণ করে দিয়েছে প্রতিবন্ধী মানেই সমাজের বোঝা নয়। সে শিক্ষা ক্যাডারের পর বলেছিল প্রশাসন ক্যাডার হবে, আজ তা বাস্তব।”
কার্তিকপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ বলেন, “উল্লাস ছিল খুব মেধাবী এবং আত্মমর্যাদাসম্পন্ন। তার সাফল্যে আমরা গর্বিত। আশা করি, সে সমাজের কল্যাণে আরও বড় ভূমিকা রাখবে।”
উল্লাস পালের জীবনের এই গল্প কেবল এক ব্যক্তির অর্জন নয়, এটি একটি প্রেরণার গল্প। যারা স্বপ্ন দেখেন এবং তার পেছনে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন, তাদের জন্য উল্লাস পালের সাফল্য এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
No comments