কেন ‘শাপলা’ প্রতীকের পেছনে এনসিপির এত আগ্রহ?
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) রাজনৈতিক দল হিসেবে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধনের আবেদন করেছে। এ সময় তারা দলীয় প্রতীক হিসেবে দেশের জাতীয় ফুল শাপলা চাইলে, তা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শুরু হয় ব্যাপক আলোচনা ও বিতর্ক।
শাপলার প্রতি এনসিপির আগ্রহ
বিবিসি বাংলায় মুকিমুল আহসানের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এনসিপির নেতাকর্মীরা দলীয় প্রতীক হিসেবে শাপলার পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছেন। যদিও বিকল্প প্রতীক হিসেবে কলম ও মোবাইল ফোনকেও তালিকায় রেখেছে দলটি, তবে মূল পছন্দ ‘শাপলা’।
এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম জানান, শাপলা বাংলাদেশের নদী, প্রকৃতি ও জলাশয়ের প্রতিচ্ছবি। তাই এটি রাজনীতির প্রতীকও হতে পারে। তিনি বলেন, “আমরা চাই রাজনীতিতে গ্রামের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠুক। এজন্য শাপলাকে প্রতীক হিসেবে চেয়েছি।
প্রতীক হিসেবে শাপলা চাওয়ার পেছনের যুক্তি
দলের দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, প্রতীক হওয়া উচিত এমন কিছু, যার সঙ্গে মানুষ নিজেদের সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে। তার মতে, “শাপলা নদীমাতৃক বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। দেশের প্রতিটি অঞ্চলে শাপলার উপস্থিতি রয়েছে। এটি জনমানুষের চেনা প্রতীক।
শাপলা নিয়ে বিতর্ক কেন?
অনেকেই সামাজিক মাধ্যমে প্রশ্ন তুলেছেন, শাপলা জাতীয় প্রতীক—এটি কীভাবে একটি দলের প্রতীক হতে পারে?
সংবিধান অনুযায়ী, বাংলাদেশের জাতীয় প্রতীক হলো—উভয় পাশে ধানের শীষ দিয়ে ঘেরা পানিতে ভাসমান শাপলা, যার উপরে রয়েছে পাটগাছের তিনটি পাতা ও পাশে দুটি করে তারকা চিহ্ন।
আইন বিশেষজ্ঞ শাহদীন মালিকের মতে, “জাতীয় প্রতীক বলা হলেও শাপলাই সেখানে প্রধান। তাই এটি কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতীক হওয়া উচিত নয়।”
সাবেক সচিব ও নির্বাচন বিশ্লেষক আবু আলম শহীদ খান বলেন, জাতীয় প্রতীকে ধানের শীষ ও পাটগাছ থাকলেও শাপলা সেখানে বেশি দৃশ্যমান। তাই এটি জাতীয় প্রতীকের প্রতীকী রূপ বহন করে, যার কারণে এটি দলীয় প্রতীক হওয়া অনুচিত।
তবে পাল্টা যুক্তিও রয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, জাতীয় প্রতীকে ধানের শীষও রয়েছে, অথচ বিএনপি সেটিকে বহুদিন ধরে দলীয় প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করছে। তাই শুধু শাপলা প্রতীক হিসেবে ব্যবহারেও আপত্তি থাকা উচিত নয়।
সাবেক নির্বাচন কর্মকর্তা জেসমিন টুলী বলেন, “জাতীয় ফুল কিংবা গাছ যদি দলীয় প্রতীক হতে পারে, তাহলে জাতীয় ফুল শাপলা নিয়ে আপত্তির যৌক্তিকতা নেই।” উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের প্রতীক হিসেবে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির প্রতীক কাঁঠাল, যা জাতীয় ফল।
শাপলা প্রতীক নিয়ে প্রতিযোগিতা
শাপলা প্রতীক চেয়ে এনসিপির আবেদনের কয়েকদিন আগে নাগরিক ঐক্যও তাদের পুরোনো প্রতীক ‘কেটলি’ বাদ দিয়ে ‘শাপলা’ বা ‘দোয়েল পাখি’ চাইতে নির্বাচন কমিশনে আবেদন করে।
এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, এনসিপির আগে নাগরিক ঐক্য কেন শাপলা প্রতীক চাইল? জবাবে নাগরিক ঐক্যের নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, “আমরা আগে নিশ্চিত ছিলাম না জাতীয় প্রতীক নির্বাচন কমিশন দলীয় প্রতীক হিসেবে দেবে কিনা। পরে সিদ্ধান্ত নিয়ে আবেদন করেছি।”
ইসির ভূমিকা কী হবে?
বর্তমানে বাংলাদেশে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল ৫০টি। সংসদ নির্বাচনের জন্য তফসিলভুক্ত প্রতীক আছে ৬৯টি। এরই মধ্যে প্রায় ১৫০টি নতুন দল নিবন্ধনের আবেদন করেছে। তাদের প্রতীক বরাদ্দ দিতে গিয়ে নির্বাচন কমিশন ১১৫টি প্রতীক নিয়ে একটি খসড়া তালিকা তৈরি করেছে। সেখানে ‘শাপলা’ও রাখা হয়েছে, তবে তা এখনো চূড়ান্ত অনুমোদন পায়নি।
নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাছউদ বলেন, “শাপলা তালিকায় রাখা হলেও এখনো চূড়ান্ত হয়নি। যদি এটি অন্তর্ভুক্ত হয়, তখন যেসব দল এ প্রতীক চেয়েছে, তাদের আবেদন পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। কার আবেদন বেশি গ্রহণযোগ্য, সেটাই তখন বিবেচ্য হবে।”
শেষ কথা
শাপলা প্রতীক নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে স্পষ্ট প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। শাপলার গ্রামীণ এবং পরিচিত প্রতিচ্ছবি হিসেবে জনপ্রিয়তা একদিকে, আবার জাতীয় প্রতীকের অংশ হিসেবে বিতর্ক অন্যদিকে। এখন দেখার বিষয়, নির্বাচন কমিশন শেষ পর্যন্ত কাকে এই প্রতীক বরাদ্দ দেয় এবং কতটা স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সে সিদ্ধান্তে পৌঁছায়।
No comments