প্রবাসীদের স্বপ্ন কি অধরাই থাকবে?
প্রতি বছর ১৬ জুন পালিত হয় আন্তর্জাতিক পারিবারিক রেমিট্যান্স দিবস। জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক কৃষি উন্নয়ন তহবিল (IFAD)-এর সহায়তায় ২০১৫ সাল থেকে এই দিনটি উদযাপন করা হচ্ছে। এবারের থিম ছিল—“রেমিট্যান্স: পরিবার ও উন্নয়ন”। দিবসটির উদ্দেশ্য হলো প্রবাসী কর্মীদের আত্মত্যাগ ও তাদের পাঠানো রেমিট্যান্সের মাধ্যমে পরিবার ও দেশের অর্থনীতিতে অবদানের স্বীকৃতি দেওয়া।
রেমিট্যান্সের পটভূমি ও বৈশ্বিক প্রভাব
রেমিট্যান্স নতুন কোনো ধারণা নয়। ঔপনিবেশিক যুগ থেকেই শ্রমিকদের বিদেশে পাঠিয়ে দেশে অর্থ পাঠানোর প্রথা চালু ছিল। আজ সেই রূপ নিয়েছে একটি বৈধ, নিয়ন্ত্রিত ও প্রযুক্তিনির্ভর ব্যবস্থায়।
বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ২৮০ মিলিয়ন মানুষ কর্মসংস্থানের জন্য নিজ দেশ ছেড়ে বিদেশে বসবাস করছেন। বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২৪ সালে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই বিপুল অঙ্কের অর্থ বৈশ্বিক অর্থনীতিতে গুরত্বপূর্ণ অবদান রাখছে, দারিদ্র্য হ্রাস করছে এবং সামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করছে।
শীর্ষ পাঁচটি রেমিট্যান্সপ্রাপ্ত দেশ হচ্ছে:
-
ভারত (১২৯ বিলিয়ন ডলার)
-
মেক্সিকো (৬৮ বিলিয়ন)
-
চীন (৪৮ বিলিয়ন)
-
ফিলিপাইন (৪০ বিলিয়ন)
-
পাকিস্তান (৩৩ বিলিয়ন)
ছোট ছোট দেশগুলোর জন্য রেমিট্যান্স একটি প্রধান অর্থনৈতিক ভিত্তি। যেমন:
-
তাজিকিস্তানে জিডিপির ৪৫%
-
টোঙ্গায় ৩৮%
-
নিকারাগুয়া ও লেবাননে ২৭%
-
সামোয়ায় ২৬%
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে রেমিট্যান্স
১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ সরকারিভাবে প্রথম শ্রমিক বিদেশে পাঠায়। এরপর থেকেই রেমিট্যান্স দেশের বৈদেশিক আয়ের প্রধান উৎসে পরিণত হয়। ১৯৮০-৯০-এর দশকে শ্রমবাজার সম্প্রসারিত হয় মধ্যপ্রাচ্যের বাইরেও।
২০০০ সালের পর থেকে ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে রেমিট্যান্স প্রেরণ সহজতর হয়। এর ফলে প্রবাসী আয় অর্থনীতির অন্যতম স্তম্ভে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বে ষষ্ঠ বৃহত্তম রেমিট্যান্সপ্রাপ্ত দেশ।
উল্লেখযোগ্য পরিসংখ্যান:
-
২০২৩ সালে মোট রেমিট্যান্স: ২২ বিলিয়ন ডলার
-
২০২৪ সালে (প্রায়): ২৭ বিলিয়ন ডলার
-
এটি ২৩% বৃদ্ধি নির্দেশ করে
-
২০২৪ সালের জিডিপির ৬-৭% আসে এই রেমিট্যান্স থেকেই
‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিকস’-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে বাংলাদেশের জিডিপি ২ হাজার ৮৯ দশমিক ৩৯ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে রেমিট্যান্স বিশাল ভূমিকা রাখছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল রাখায়।
রেমিট্যান্সের বহুমাত্রিক প্রভাব
১. পরিবারে স্বস্তি: পরিবারের দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে সাহায্য করে
২. শিক্ষা ও স্বাস্থ্য: সন্তানদের শিক্ষায় ও চিকিৎসা খাতে খরচ হয়
৩. উদ্যোক্তা সৃষ্টি: প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে অনেকে ছোট ব্যবসা শুরু করেন
৪. মুদ্রার রিজার্ভ: বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডার সমৃদ্ধ হয়
এটি শুধু অর্থনৈতিক নয়, সামাজিকভাবেও গুরুত্বপূর্ণ। খাদ্য নিরাপত্তা, নারীর ক্ষমতায়ন ও গ্রামীণ অর্থনীতিকে সক্রিয় রাখতে রেমিট্যান্স অগ্রণী ভূমিকা রাখে।
প্রবাসীদের বাস্তবতা ও স্বপ্ন
প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষ কাজের খোঁজে বাংলাদেশ ছাড়েন। অধিকাংশের গন্তব্য মধ্যপ্রাচ্য। শুধু সৌদি আরবেই ২৫ লাখের বেশি বাংলাদেশি কাজ করছেন।
তাদের স্বপ্ন থাকে—একটি পাকা ঘর, সন্তানের উচ্চশিক্ষা বা ছোট ব্যবসা। কিন্তু স্বপ্নপূরণের পথে শুরুতেই পড়েন দালাল চক্রের খপ্পরে। উচ্চ খরচে বিদেশ যাওয়ার ফলে অনেকে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন। বিদেশে পৌঁছেও বিপাকে পড়েন—চুক্তিভঙ্গ, বেতন না পাওয়া, দুর্বল আবাসন, অমানবিক কাজের পরিবেশ।
বছরের পর বছর খেটে উপার্জিত অর্থ পাঠালেও নিজের জন্য কিছুই থাকে না। দেশে ফিরে পান না কাজ বা সামাজিক সম্মান। এমনকি রেমিট্যান্স পাঠাতেও বাধা থাকে—অনেকে এখনো হুন্ডি বা অবৈধ চ্যানেল ব্যবহার করেন।
সমাধানের দিকনির্দেশনা
প্রবাসীদের স্বপ্ন পূরণ করতে রাষ্ট্রকে নিতে হবে কার্যকর পদক্ষেপ:
১. রেমিট্যান্স প্রেরণে নিরাপদ ব্যবস্থা
-
ব্যাংক ও ডিজিটাল পদ্ধতির বিস্তার
-
শতভাগ পরিবারকে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির আওতায় আনা
২. দালাল চক্র নির্মূল
-
অভিবাসন প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা
-
সরকারি প্রশিক্ষণ, তথ্য ও আইনি সহায়তা
৩. প্রবাসীদের পরিবার ও সম্পদের নিরাপত্তা
-
সরকারি ও বেসরকারি সেবায় অগ্রাধিকার
৪. দেশে ফেরা শ্রমিকদের পুনর্বাসন
-
দক্ষতা উন্নয়ন, ক্ষুদ্রঋণ, উদ্যোক্তা সহায়তা
৫. দূতাবাসগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি
-
দ্রুত, মানবিক ও ফলপ্রসূ সেবা নিশ্চয়তা
৬. ব্যাংকিং প্রণোদনা ও বীমা সুবিধা
-
২.৫% রেমিট্যান্স প্রণোদনার পাশাপাশি স্বাস্থ্য, জীবন ও শিক্ষা বীমা চালু
No comments