Header Ads

৯ মাসে দ্বিগুণ খেলাপি ঋণ: কেন এমন হলো?

 
       

৯ মাসে দ্বিগুণ খেলাপি ঋণ: কেন এমন হলো?



আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ভয়াবহ গতিতে বেড়ে গেছে। যদিও আওয়ামী লীগের শাসনামলেও খেলাপি ঋণ ক্রমাগত বাড়ছিল, তখন তা ধীরে ধীরে বাড়লেও নানা উপায়ে তা আড়াল করার চেষ্টা চলত। নির্বাচনের আগে বিভিন্ন সময় বিশেষ সুবিধার মাধ্যমে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ দেওয়া হতো। দেশে বা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কোনো সংকট দেখা দিলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বিশেষ ছাড় দেওয়া হতো—ঋণ খেলাপি হলেও তা তালিকাভুক্ত করা হতো না। এসব সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ সরকারের সময়েই খেলাপি ঋণ বড় আকার ধারণ করে।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার সময় খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। গত বছরের জুনে, সরকার বিদায়ের আগে, এই ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকায়। অথচ ২০২৫ সালের মার্চ শেষে এই খেলাপি ঋণ গিয়ে দাঁড়ায় ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকায়। অর্থাৎ নতুন সরকার গঠনের মাত্র ৯ মাসেই খেলাপি ঋণ প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে।

কেন এমন হলো?

খেলাপি ঋণ সাধারণত তখনই হয়, যখন কোনো ঋণ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পরিশোধ করা হয় না। ব্যাংকগুলো গ্রাহকের আমানতের টাকাই ঋণ হিসেবে বিতরণ করে, ফলে সেই ঋণ না ফেরত আসলে আমানতকারীর অর্থ ফেরত দেওয়ায় সমস্যা দেখা দেয়। বর্তমানে অনেক ব্যাংক এই সমস্যায় ভুগছে, কারণ তাদের ঋণ আদায় হচ্ছে না।

খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার পেছনে কয়েকটি মূল কারণ রয়েছে:

  1. আওয়ামী লীগের সময় দেওয়া অনিয়মিত ঋণ: আগের সরকারে ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের দেওয়া অনেক অনিয়মিত ঋণ এখন খেলাপি হয়ে পড়ছে।

  2. গোপন খেলাপি ঋণ প্রকাশ: আগে যেসব খেলাপি ঋণ তথ্য গোপন রাখা হয়েছিল, সেগুলো এখন প্রকাশিত হচ্ছে।

  3. ব্যবসায়িক মন্দা: দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দার কারণে অনেক ব্যবসায়ী সময়মতো ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না।

  4. নতুন ঋণ শ্রেণিকরণ নীতি: বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণ শ্রেণিকরণে আন্তর্জাতিক রীতি পুনরায় চালু করেছে। এখন নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ঋণ পরিশোধ না হলে সেটি ৯০ দিন পরে খেলাপি হিসেবে গণ্য করা হয়। যদিও এই নিয়ম কার্যকর হয়েছে এপ্রিল ২০২৫ থেকে, তবে কিছু ব্যাংক আগে থেকেই তা অনুসরণ করতে শুরু করেছে।

কোন ব্যাংকগুলো বেশি দায়ী?

খেলাপি ঋণ বৃদ্ধিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে একীভূত হতে যাওয়া পাঁচটি ব্যাংক—

  • ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক

  • সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক

  • ইউনিয়ন ব্যাংক

  • গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক

  • এক্সিম ব্যাংক

এসব ব্যাংকের মধ্যে চারটি ছিল এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে, যা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। এই গ্রুপ নিজেরা বা নামে-বেনামে বিপুল পরিমাণ অর্থ তুলে নিয়েছে, যা ফেরত না দেওয়ায় তা এখন খেলাপি হিসেবে গণ্য হচ্ছে। শুধু এই পাঁচ ব্যাংকের খেলাপি ঋণই বেড়েছে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা।

এছাড়া খেলাপি ঋণের শীর্ষে রয়েছে:

  • জনতা ব্যাংক

  • অগ্রণী ব্যাংক

  • ন্যাশনাল ব্যাংক

  • আইএফআইসি

  • ইউনিয়ন ব্যাংক

এই ব্যাংকগুলোকে বিশেষ নজরদারিতে রাখা হয়েছে তাদের আর্থিক অবস্থা ঠিক রাখতে।

আওয়ামী লীগ-ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের দুর্দশা

সরকার পরিবর্তনের পর আওয়ামী লীগ–ঘনিষ্ঠ অনেক ব্যবসায়ীর ব্যবসা ধাক্কা খেয়েছে। ফলে তারা ঋণ পরিশোধে অক্ষম হয়ে পড়েছে। আগে যেসব ঋণ কৌশলে নিয়মিত দেখানো হয়েছিল, এখন তা খেলাপি হয়ে পড়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংক সব ঋণের প্রকৃত অবস্থা দেখানোর নির্দেশনা দিয়েছে। ফলে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ঋণ গোপন রাখার সুযোগ আর নেই, যার ফলে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

বিশেষজ্ঞদের মতামত

অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ও ব্যাংকার সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ বলেন, এই পরিস্থিতি সামাল দিতে বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগ জরুরি। তিনি মনে করেন, যারা এখনো ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন এবং দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছেন, তাদের ঋণ পুনঃনিয়মিত করার মাধ্যমে সহযোগিতা করা দরকার। নজরদারি বাড়িয়ে তাদের ব্যবসা সচল রাখতে পারলে দেশেরই মঙ্গল হবে। কারণ কারও ব্যবসা বন্ধ করে দিলে জাতীয় অর্থনীতির ক্ষতিই হবে। দেশে বিনিয়োগ প্রবাহ সচল রাখা অত্যন্ত জরুরি।

No comments

Powered by Blogger.