ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ এখন রেকর্ড পরিমাণে পৌঁছেছে
বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ভয়াবহ রেকর্ড গড়েছে। ২০২৫ সালের মার্চ শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা। যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ২৪ দশমিক ১৩ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২ লাখ ৩৮ হাজার ৪০ কোটি টাকা। ২০২৪ সালের মার্চ শেষে এ ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা।
তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রকৃত খেলাপি ঋণের চিত্র আরও ভয়াবহ। অর্থনীতিবিদদের অনেকেই মনে করেন, অবলোপন, পুনঃতফসিল ও মামলার অন্তর্ভুক্ত ঋণ মিলিয়ে প্রকৃত খেলাপি ঋণ ৭ লাখ কোটি টাকাও ছাড়িয়ে যেতে পারে।
রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রভাব
৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নেতৃত্বে পরিবর্তন আসে। নতুন গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর ব্যাংকগুলোকে খেলাপি ঋণের প্রকৃত তথ্য প্রকাশে উৎসাহ দেন। এর পর থেকেই হঠাৎ করেই বাড়তে থাকে খেলাপির হিসাব।
২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত তিনটি প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২ লাখ ৮ হাজার ৯৪৩ কোটি টাকা।
-
২০২৪ সালের জুনে ছিল ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯২ কোটি টাকা
-
সেপ্টেম্বরে বেড়ে হয় ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৯৭ কোটি টাকা
-
ডিসেম্বরে দাঁড়ায় ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৪ কোটি টাকা
-
আর সর্বশেষ মার্চে তা ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩৫ কোটিতে গিয়ে ঠেকে
অর্থাৎ মাত্র ৯ মাসে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে খেলাপি ঋণ।
কোন ব্যাংক কত খেলাপি?
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে,
-
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক: মোট ঋণ ৩ লাখ ১৯ হাজার ৭০২ কোটি, খেলাপি ১ লাখ ৪৬ হাজার ৪০৬ কোটি (৪৫.৭৯%)
-
বেসরকারি ব্যাংক: ঋণ ১৩ লাখ ১০ হাজার ৩৮৪ কোটি, খেলাপি ২ লাখ ৬৪ হাজার ১৯৫ কোটি (২০.১৬%)
-
বিশেষায়িত ব্যাংক: ঋণ ৪৪ হাজার ৮৮৬ কোটি, খেলাপি ৬ হাজার ৪৯৪ কোটি (১৪.৪৭%)
-
বিদেশি ব্যাংক: ঋণ ৬৭ হাজার ১৩ কোটি, খেলাপি ৩ হাজার ২৩৮ কোটি (৪.৮৩%)
এস আলম গ্রুপের প্রভাবিত ব্যাংকগুলোতে ব্যাপক খেলাপি
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ বিতর্কিত ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপ নিয়ন্ত্রিত ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকে খেলাপি ঋণের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ঘটেছে।
এছাড়া বেক্সিমকো গ্রুপ ও নাসা গ্রুপের মতো বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠীগুলোরও নাম এসেছে খেলাপি তালিকায়।
বিশ্লেষকরা কী বলছেন?
অর্থনীতিবিদ এম হেলাল আহমেদ বলেছেন, দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক প্রভাবে অনেক বড় খেলাপি প্রতিষ্ঠান ব্যাংকের রেকর্ডে ‘ভালো গ্রাহক’ ছিল। তারা একাধিক ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে একটি কোম্পানি দেখিয়ে। অনেকেই আবার অর্থ বিদেশে পাচার করেছে।
তাঁর মতে, খেলাপি কমাতে চাই—
-
প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন
-
বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর নজরদারি
-
জামানতের নিরাপত্তা নিশ্চিত
-
প্রয়োজনে ব্যাংকের সংখ্যা হ্রাস
-
সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে বিক্রি
-
কার্যকর টাস্কফোর্স
-
অর্থপাচারকারীদের বিরুদ্ধে মামলা ও বিচার
প্রভিশন ঘাটতিও বিপজ্জনক
ব্যাংকগুলোকে ঋণ খেলাপির বিপরীতে ২ লাখ ৭৫ হাজার ১০৩ কোটি টাকা প্রভিশন রাখতে বলা হয়েছিল। তবে তারা সংরক্ষণ করেছে মাত্র ১ লাখ ৪ হাজার ৪৪৭ কোটি টাকা। এতে করে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৭০ হাজার ৬৫৫ কোটি টাকা।
এছাড়া ক্ষতিজনক মানের মন্দ ঋণের পরিমাণও ৩ লাখ ৪২ হাজার ৬৪ কোটি টাকা।
২০০৯ থেকে ২০২৫: ২০ গুণ ঋণ খেলাপি বৃদ্ধি
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার দায়িত্ব নেওয়ার সময় খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। সেখানে ১৬ বছরের ব্যবধানে তা ২০ গুণ বেড়ে পৌঁছেছে ৪ লাখ ২০ হাজার কোটির ঘরে।
No comments