বিশ্ব যখন নীরব, গাজার ঈদ তখন রক্তে রঞ্জিত
ঈদুল আজহা মানে আনন্দ, ত্যাগ আর ভালোবাসার উৎসব। এ উৎসবের মূল শিক্ষা হলো আত্মত্যাগ ও দরিদ্রদের পাশে দাঁড়ানো। প্রতিটি মুসলিম পরিবারের ঘরে কোরবানির পশু থাকে, থাকে ভালো খাবার আর নতুন পোশাক। কিন্তু গাজার জন্য এ উৎসব যেন হয়ে উঠেছে রক্ত, ধ্বংস আর কান্নার আরেক নাম।
এ বছর গাজার ঈদ আর আনন্দ বয়ে আনেনি। সেখানে কোরবানির পশু নয়, কোরবানি হচ্ছে মানুষ—শিশু, নারী ও নিরপরাধ পুরুষ। ঈদের সকাল যেখানে হওয়া উচিত ছিল তাকবিরের ধ্বনিতে মুখরিত, সেখানে ভেসে এসেছে শুধু বোমার শব্দ, আর্তনাদ আর মৃত্যু।
গাজার বহু এলাকায় ঈদগাহ ধ্বংস হয়ে গেছে। যেখানে একসময় নামাজ পড়া হতো, আজ সেখানে ধ্বংসস্তূপ। যে শিশুটি নতুন জামা পরে ঈদগাহে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেছিল, আজ সে হয়তো হাসপাতালের বেডে কাতরাচ্ছে, কিংবা নিথর হয়ে পড়ে আছে ধ্বংসস্তূপের নিচে। ঈদের নামাজ, কোরবানি বা খুশির কোনো রংই আর সেখানে নেই।
এই ভয়াবহ বাস্তবতার সামনে দাঁড়িয়ে এক কঠিন প্রশ্ন উঁকি দেয়—এই হত্যা, এই নির্মমতা কার দায়? কেবল দখলদার শক্তির? নাকি তাদেরও, যারা মানবাধিকারের বুলি আওড়ায় কিন্তু গাজা প্রসঙ্গে চুপ থাকে? যারা একদিকে অস্ত্র বিক্রি করে, আর অন্যদিকে ‘শান্তির বার্তা’ দেয়?
আর মুসলিম বিশ্ব? অনেক রাষ্ট্রের নেতৃত্ব যেন নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় এতটাই ব্যস্ত যে গাজার আর্তনাদও তাদের কানে পৌঁছায় না। তাদের নিরবতা কি ভিন্ন এক ধরণের সহিংসতা নয়?
ড. হানান আশরাওয়ির কথায়, “প্রতি ঈদেই গাজা কাঁদে, আর বিশ্ব থাকে নীরব। এই নীরবতাই সবচেয়ে বড় সহিংসতা।”
আর্চবিশপ দেশমন্ড টুটু ফাউন্ডেশনের ভাষায়, “যখন ঈদের দিনে শিশু কাঁদে, প্রার্থনা হয় ধ্বংসস্তূপে, তখন তা শুধু মানবতা নয়, ঈশ্বরকেও অপমান করা।”
মার্কিন অধিকারকর্মী কোরনেল ওয়েস্ট বলেন, “এই রক্তমাখা ঈদ আমাদের সকলের বিবেকের পরীক্ষা। কেউ কোরবানি দেয় আত্মশুদ্ধির জন্য, আর কেউ মানুষ হত্যা করে নিজের দখলদারিত্ব টিকিয়ে রাখে।”
একটি শিশু যখন বলে, “আমার বাবা-মায়ের রক্তের দায় কে নেবে?”—তখন শুধু একটি দেশ নয়, গোটা বিশ্বব্যবস্থাকে দায় নিতে হয়।
আমরা যারা প্রতিদিন গাজার হৃদয়বিদারক ছবি দেখে পাশ কাটিয়ে যাই, মনে করি ‘আমার কিছু করার নেই’—আমরাও কি একপ্রকার নীরব সহযোদ্ধা নই এই সহিংসতার?
এই দায় একা কারও নয়। এই দায় পড়ে প্রতিটি শক্তিধর দেশের নিরবতায়, বড় বড় গণমাধ্যমের পক্ষপাতিত্বে, এবং মুসলিম বিশ্বের নীরব নেতৃত্বের নিষ্ক্রিয়তায়।
আজকের ঈদে তাকবিরের মাঝেও এক প্রশ্ন জেগে ওঠে—“আর কত ঈদ আসবে, যেখানে কেউ বুক চাপা কান্না লুকাবে, আর কেউ কবরস্থানে প্রিয়জন খুঁজবে?”
এই প্রশ্নের উত্তর একদিন ইতিহাস দেবে—আর সেদিন কেউ পার পাবে না। নীরবতা আর মুখোশ কোনোদিন রক্ষা করতে পারবে না সত্যের মুখোমুখি হওয়া থেকে।
No comments