Header Ads

ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধে সংকট: বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানিতে বড় চ্যালেঞ্জ

    
   

ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধে সংকট: বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানিতে বড় চ্যালেঞ্জ


সম্প্রতি শুরু হওয়া ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি খাতে বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন দেশের ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা। যদিও সরাসরি এই দুই দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের তেমন বাণিজ্যিক সম্পর্ক নেই, তবে যুদ্ধ পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যপথে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে, যার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়বে বলে তারা মনে করছেন।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, ইউরোপ ও আমেরিকায় তৈরি পোশাক পাঠাতে হরমুজ প্রণালি ও সুয়েজ খাল ব্যবহার করা হয়। এ দুটি পথ ব্যবহার করলে সময় ও খরচ কম হয়। কিন্তু চলমান সংঘাতে হরমুজ প্রণালিতে বাধা সৃষ্টি হলে রপ্তানি খরচ ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে। একই সঙ্গে বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটলে বিদেশি ক্রেতার চাহিদাও কমে যেতে পারে।

তারা আরও বলছেন, মধ্যপ্রাচ্য তেল ও খনিজসম্পদের অন্যতম প্রধান উৎস। এ অঞ্চলে যুদ্ধ শুরু হলে তা বিশ্বব্যাপী অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক বাণিজ্য পথগুলো হুমকির মুখে পড়বে। ফলে পণ্যের দাম বাড়বে এবং ব্যবসায়িক স্থিতিশীলতায় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ইতিমধ্যেই জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে, শিপিং খরচ বেড়েছে এবং উৎপাদন কার্যক্রমেও প্রভাব দেখা যাচ্ছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এই যুদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতির জন্য সাম্প্রতিক একটি বড় ভূ-রাজনৈতিক ঝাঁকুনি। ২০১৮ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ট্যারিফ আরোপের সিদ্ধান্তের পর এটি আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে।

ব্রেন্ট ক্রুড অয়েলের দাম ইতিমধ্যে প্রায় ৫ শতাংশ বেড়েছে। যদিও কিছুদিন আগেই তা ১৩ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছিল। উল্লেখযোগ্য, বিশ্বে উৎপাদিত মোট তেলের এক-তৃতীয়াংশ আসে মধ্যপ্রাচ্য থেকে। এর প্রভাব ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক শেয়ারবাজারেও পড়েছে—ইউরোপের শেয়ারবাজার ১.১ শতাংশ ও এস অ্যান্ড পি ৫০০ ফিউচারস ১.৩ শতাংশ কমে গেছে।

এই সংঘাত এমন এক সময় শুরু হয়েছে, যখন বৈশ্বিক স্টক সূচক মাত্রই সর্বোচ্চ উচ্চতায় পৌঁছেছিল এবং এপ্রিল থেকে তা ২০ শতাংশেরও বেশি বেড়েছিল। বিনিয়োগকারীরা এখন গভীরভাবে পরিস্থিতির দিকে নজর রাখছেন।

বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক মোহিউদ্দিন রুবেল বলেন, ইরান-ইসরায়েল সংঘাত নতুন করে বৈশ্বিক বাণিজ্যে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করছে। ট্রাম্পের ট্যারিফ-সংক্রান্ত ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার পর আবার এমন সংঘাত শুরু হওয়ায় বিশ্ব অর্থনীতি ঝুঁকির মুখে পড়েছে। এরই মধ্যে জ্বালানি খাতে দাম বেড়েছে, শিপিং খরচও বৃদ্ধি পেয়েছে এবং উৎপাদন কার্যক্রমে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বিনিয়োগকারীদের মধ্যে উদ্বেগ বাড়ছে, যার প্রভাব স্টক মার্কেটেও পড়ছে।

তিনি আরও বলেন, বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ জ্বালানি তেল মধ্যপ্রাচ্যে উৎপাদিত হয়। যদি হরমুজ প্রণালি বন্ধ হয়ে যায়, তবে ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ব্যারেলপ্রতি ১২০ থেকে ১৩০ ডলার পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে, যা বিশ্ব অর্থনীতির জন্য বিশাল চাপ তৈরি করবে।

তিনি জানান, শুধু জ্বালানি তেল নয়, সুয়েজ খাল দিয়েও বিপুল পরিমাণ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য হয়। যদি সেখানে জাহাজ চলাচলে বাধা আসে, তবে বিকল্প হিসেবে আফ্রিকার কেপ অব গুড হোপ হয়ে ঘুরে যেতে হবে। এতে সময় প্রায় ১৫ দিন বাড়বে এবং শিপিং খরচ প্রতি কনটেইনারে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে।

শিপিং খাতসংশ্লিষ্টরা জানাচ্ছেন, হরমুজ প্রণালি নিয়ে সবচেয়ে বেশি উদ্বেগ তৈরি হয়েছে, কারণ এটি দিয়ে বিশ্বে সরবরাহ হওয়া মোট তেলের প্রায় এক-চতুর্থাংশ পরিবাহিত হয়। ইরানের সীমান্ত ঘেঁষা এই পথটি যেকোনো ধরনের বিঘ্ন বৈশ্বিক জ্বালানি সরবরাহে বড় ধরনের সংকট তৈরি করতে পারে।

তারা আরও বলছেন, ইরানের মিত্র গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে এমন কিছু রয়েছে, যারা সুয়েজ খালের ওপর প্রভাব বিস্তারের সক্ষমতা রাখে। এই খাল ভূমধ্যসাগর ও লোহিত সাগরের সংযোগস্থল, যা বৈশ্বিক বাণিজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ রুট। গত বছর ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা রেড সাগরে তাদের সামরিক উপস্থিতি ও সক্ষমতা দেখিয়েছিল।

এ বিষয়ে পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী ড. মাসরুর রিয়াজ বলেন, ইসরায়েলের সাম্প্রতিক হামলা ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হওয়ায় এর প্রভাব শুধু একটি অঞ্চলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। এটি বৈশ্বিক বাণিজ্য ও সরবরাহ ব্যবস্থাকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করতে পারে। তিনি জানান, ইরান-সমর্থিত গোষ্ঠীগুলোর সুয়েজ খাল দখলের সক্ষমতা রয়েছে। যদি তারা ওই পথ অবরুদ্ধ করে, তাহলে বিশ্ববাণিজ্যে বড় ধরনের ব্যাঘাত সৃষ্টি হবে। এতে শিপিংয়ের সময় ও ব্যয় ব্যাপক হারে বেড়ে যেতে পারে।

সংক্ষেপে, ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ শুধু সরাসরি জড়িত দেশগুলোর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যপথ, জ্বালানি সরবরাহ, শিপিং খরচ এবং উৎপাদন কার্যক্রমে ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে, যা বাংলাদেশের মতো আমদানিনির্ভর দেশের অর্থনীতিতেও বড় ধরনের চাপ তৈরি করতে পারে।

No comments

Powered by Blogger.