হাসিনার ‘আস্থাভাজনদের’ পদায়ন: প্রশাসনে অদৃশ্য বাজারের চেহারা
গত ১৭ বছর ধরে প্রশাসনে পদোন্নতি ও পদায়নের ক্ষেত্রে ব্যাপক বৈষম্যের অভিযোগ উঠেছে। বিশেষ করে, একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে অগ্রাধিকার দিয়ে উচ্চপদস্থ পদগুলোতে নিয়োগ দেওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অন্যদিকে, দীর্ঘদিন ধরে বঞ্চিত থাকা কর্মকর্তারা এখনো ন্যায্য পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত রয়েছেন।
সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকার প্রশাসনে ১৯৪ জন উপসচিবকে যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতি দিয়েছে। তবে অভিযোগ রয়েছে যে, এই তালিকায় অনেক যোগ্য ও অভিজ্ঞ কর্মকর্তাকে বাদ দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে, পূর্ববর্তী সরকারের ‘আস্থাভাজন’ বলে পরিচিত কর্মকর্তাদেরই গুরুত্বপূর্ণ পদে পুনর্বহাল বা পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে।
সরকারি প্রশাসনে সাম্প্রতিক কিছু নিয়োগ ও পদোন্নতি বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। যেমন, পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) অথোরিটির সাবেক প্রধান নির্বাহী মোস্তাফিজুর রহমানকে ওএসডি করার মাত্র পাঁচ মাস পর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। একইভাবে, সিনিয়র সচিব কামাল হোসেনও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে পদোন্নতির সুবিধা পেয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে, রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার কারণে এ ধরনের কর্মকর্তারা প্রশাসনে প্রভাব বিস্তার করছেন।
বৈষম্যের শিকার কর্মকর্তাদের দাবি, প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে শুধুমাত্র নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর কর্মকর্তাদেরই সুযোগ দেওয়া হচ্ছে, ফলে যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও অনেক কর্মকর্তা অবহেলিত থেকে যাচ্ছেন।
বৈষম্যবিরোধী কর্মচারী ঐক্য ফোরাম থেকে দাবি করা হয়েছে, প্রশাসনে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার জন্য আগের সরকারের সময় নিয়োগ পাওয়া বিতর্কিত কর্মকর্তাদের পদবী পুনর্বিবেচনা করা উচিত এবং যোগ্য কর্মকর্তাদের ন্যায্য পদোন্নতি নিশ্চিত করা উচিত। প্রশাসনের স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করা জরুরি।
বৈষম্যবিরোধী কর্মচারী ঐক্য ফোরামের সমন্বয়ক ও বিএনপি চেয়ারপারসনের একান্ত সচিব এবিএম আব্দুস সাত্তার প্রশাসনে নিয়োগ ও পদোন্নতির ব্যাপারে গুরুতর অভিযোগ তুলেছেন। ইনকিলাবকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে ফ্যাসিস্ট সরকারের ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তারা এখনও দায়িত্ব পালন করছেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কর্মকাণ্ডকে ব্যাহত করতে তারা গোপনে নানা ধরনের অপপ্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন, যা তদন্ত করা প্রয়োজন।
তিনি আরও বলেন, "অনেক যোগ্য কর্মকর্তা সচিব পদে পদোন্নতির তালিকায় থাকলেও তাদের উন্নতি করা হচ্ছে না। অন্যদিকে, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নিয়োগ পাওয়া 'বিশ্বস্ত' কর্মকর্তারা প্রশাসনের শীর্ষ পদ থেকে শুরু করে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে নিযুক্ত হচ্ছেন। এটা কেন ঘটছে, তা আমাদের জানতে হবে।"
মোস্তাফিজুর রহমানের পদোন্নতি নিয়ে বিতর্ক
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, ২০২৩ সালের ১৪ জুলাই শেখ হাসিনা চীন সফর থেকে ফিরে এসে সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষার্থীদের নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করেন, যা ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়। ওই ঘটনার পর শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে এবং ২২ দিনের মাথায় আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার প্রশাসনে সংস্কার আনার উদ্যোগ নেয়। মন্ত্রী-এমপিদের পদ বাতিল করা হয়, পাশাপাশি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সরকারি দপ্তরের প্রধানদের অপসারণ করা হয়। এই সংস্কারের অংশ হিসেবে ২২ সেপ্টেম্বর পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) অথোরিটির সিইও মোস্তাফিজুর রহমানকে ওএসডি করা হয়।
কিন্তু পাঁচ মাসের মধ্যেই তাকে আবার সচিব পদে ফিরিয়ে এনে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়, যা নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক সৃষ্টি হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রশ্ন উঠেছে— কাদের নির্দেশে এবং কী বিনিময়ে তাকে আবার গুরুত্বপূর্ণ পদে আনা হলো?
ডিইউ নিউজ নামে একটি ফেসবুক পেজ ৪ মার্চ একটি পোস্টে লিখেছে, "শেখ হাসিনার আস্থাভাজন পিপিপি দপ্তরের সচিবকে ফের সচিব পদে নিয়োগ দিল অন্তর্বর্তী সরকার! এটি কীভাবে সম্ভব?"
মোস্তাফিজুর রহমানের ক্যারিয়ার ও ওএসডি হওয়ার ইতিহাস
মোস্তাফিজুর রহমান তার কর্মজীবনে মোট পাঁচবার ওএসডি হয়েছেন, যার মধ্যে তিনবার পদোন্নতির কারণে এবং দু’বার প্রশাসনিক কারণে।
-
১৯৯৪ সালে সহকারী সচিব হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন।
-
২০১২ সালে উপসচিব থাকাকালীন প্রথমবার ওএসডি হন।
-
২০১৭ সালে যুগ্ম সচিব পদে এবং ২০২০ সালে অতিরিক্ত সচিব পদে উন্নীত হওয়ার সময় ওএসডি করা হয়।
-
সর্বশেষ ২০২৩ সালে পিপিপি অথোরিটির সিইও থাকাকালীন প্রশাসনিক কারণে তাকে ওএসডি করা হয়।
শিক্ষাগত জীবনে তিনি মাধ্যমিক থেকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত সব পরীক্ষায় দ্বিতীয় শ্রেণিতে পাস করলেও ২০০৯ সালে নর্দান ইউনিভার্সিটি থেকে এমবিএ করে প্রথম শ্রেণি পান।
পদোন্নতিতে বৈষম্যের অভিযোগ
প্রশাসনের অভ্যন্তরে ফ্যাসিস্ট সরকারের বিশ্বস্ত কর্মকর্তারা গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরগুলোতে বহাল থাকলেও, যোগ্য কিন্তু বঞ্চিত কর্মকর্তারা পদোন্নতি পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ উঠেছে। বৈষম্যবিরোধী কর্মচারী ঐক্য ফোরাম দাবি জানিয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের পদগুলো পুনর্বিবেচনা করে যোগ্য কর্মকর্তাদের সুযোগ দেওয়া হোক।
এই বিতর্কিত নিয়োগ ও পদোন্নতির ঘটনায় প্রশাসনের অভ্যন্তরে ব্যাপক অসন্তোষ দেখা দিয়েছে, যা দ্রুত সমাধান না হলে দীর্ঘমেয়াদে প্রশাসনিক জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
No comments