 |
একদিনে প্রত্যাহার চার এসপি |
চার জেলার পুলিশ সুপারকে হঠাৎ করেই দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। তাদের নিজ নিজ জেলার জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করে আজ (মঙ্গলবার) পুলিশের সদরদপ্তরে রিপোর্ট করতে বলা হয়েছে। গতকাল (সোমবার) পুলিশ সদরদপ্তর থেকে এই নির্দেশনা জারি করা হয়।
প্রত্যাহার হওয়া এসপিরা হলেন—কক্সবাজারের মুহাম্মদ রহমত উল্লাহ, যশোরের মো. জিয়াউদ্দিন আহম্মেদ, নীলফামারীর মোহাম্মদ মোর্শেদ আলম এবং সুনামগঞ্জের আফম আনোয়ার হোসেন খান।
পুলিশ কর্মকর্তাদের মতে, এ ধরনের নির্দেশনার অর্থ হলো সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া। সাধারণত গুরুতর অভিযোগ উঠলে এভাবে প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া চালু করা হয়।
এ বিষয়ে পুলিশের সদরদপ্তরের মুখপাত্র ইনামুল হক সাগর জানান, চার জেলার এসপিকে সদরদপ্তরে রিপোর্ট করতে বলা হয়েছে। তবে তাদের প্রত্যাহারের কারণ সম্পর্কে কোনো বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি।
সুনামগঞ্জের পুলিশ সুপার আ ফ ম আনোয়ার হোসেন খান, যিনি ২৪তম বিসিএস ব্যাচের কর্মকর্তা, যোগদানের মাত্র দুই মাসের মধ্যেই নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগের মুখে পড়েন। তিনি গত ৮ সেপ্টেম্বর সুনামগঞ্জে এসপি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন।
প্রথমবার প্রকাশ্যে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে ২৮ অক্টোবর, সুনামগঞ্জ শহরের শহীদ আবুল হোসেন মিলনায়তনে আয়োজিত ‘বালু-পাথর মহাল নিয়ে জনতার ভাবনা’ শীর্ষক আলোচনায়। সেখানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মীরা অভিযোগ করেন যে, এসপির মদদে ধোপাজান বালু-পাথর মহাল লুট হয়েছে। তারা দাবি করেন, তিনি বালুখেকোদের কাছ থেকে উৎকোচ নিয়েছেন।
এই আলোচনায় উপস্থিত সাংবাদিক ও আইনজীবীরা ইঙ্গিত করে বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পৃষ্ঠপোষকতায় ৫ আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ধোপাজান বালুমহাল থেকে অন্তত ১৫০ কোটি টাকার সম্পদ লুট হয়েছে। জেলা প্রশাসন এটিকে রক্ষা করার চেষ্টা করলেও সফল হয়নি।
এছাড়া, ওসি পদায়ন, থানার এসআই ও এএসআই বদলিতে বিশেষ ক্যাশিয়ার থাকার অভিযোগও ওঠে তার বিরুদ্ধে। অভিযোগ রয়েছে, তার বিশ্বস্ত একজন স্টেনোগ্রাফার, যিনি দীর্ঘদিন যশোর এসপি অফিসে কর্মরত ছিলেন, সুনামগঞ্জে এসব বদলির নিয়ন্ত্রণ করতেন।
এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ সদরদপ্তর তাকে প্রত্যাহার করে ঢাকায় রিপোর্ট করতে নির্দেশ দিয়েছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জেলা কমিটির আহ্বায়ক ইমনুদ্দোজা অভিযোগ করেছেন যে, পুলিশ সুপার আনোয়ার হোসেন খান দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথম অনিয়মটি করেন শহরতলির ধোপাজান বালুমহাল লুটপাটে সহযোগিতা করে এবং প্রকাশ্যে উৎকোচ গ্রহণ করে।
এ ছাড়া, ‘স্যার’ না বলে ‘সাহেব’ বলায় ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন এসপি আনোয়ার হোসেন। তাঁর উত্তেজিত হওয়ার একটি ভিডিও ইতিমধ্যেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। সম্প্রতি সুনামগঞ্জে পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে গণঅধিকার পরিষদের নেতাদের সঙ্গে কথোপকথনের সময় এ ঘটনা ঘটে।
এসপি আনোয়ার বলেন, "আমি যদি আজ চাকরি ছেড়ে দিই, তাহলে কালই নির্বাচন করতে পারব। বিএনপির বড় বড় নেতাদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ আছে।" কথোপকথনের একপর্যায়ে তিনি উত্তেজিত হয়ে গণঅধিকার পরিষদের নেতা এম এস মাসুম আহমদের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং তাকে গলা ধরে বের করে দিতে বলেন।
গতকাল সন্ধ্যায় এ বিষয়ে জানতে পুলিশ সুপারের সরকারি নম্বরে ফোন দেওয়া হলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
অন্যদিকে, সাড়ে তিন লাখ পিস ইয়াবা বিক্রির অভিযোগ ওঠার পর কক্সবাজারের পুলিশ সুপার রহমত উল্লাহকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। তবে একই ঘটনায় অভিযুক্ত ডিবির ওসি জাহাঙ্গীর আলমসহ অন্যান্য সাত পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি মো. আহসান হাবীব পলাশ জানিয়েছেন, কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. রহমত উল্লাহকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। এ ঘটনায় জড়িত অন্যান্য পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে।
গত ৮ সেপ্টেম্বর মো. রহমত উল্লাহ কক্সবাজারের পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্ব নেন। এরপর থেকে তিনি জেলায় পুলিশের মধ্যে নিজস্ব বলয় গড়ে তোলার চেষ্টা করেন।
৬ জানুয়ারি ভোরে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে রামু উপজেলার কচ্ছপিয়া এলাকা থেকে ৪ লাখ ৯০ হাজার পিস ইয়াবাসহ একটি টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজার প্রাডো গাড়ি (নম্বর: ঢাকা মেট্রো-ঘ ১৩-৬২০৯) জব্দ করা হয়। অভিযান পরিচালনা করেন জেলা গোয়েন্দা শাখার ওসি জাহাঙ্গীর আলম ও এসআই সমীর গুহের নেতৃত্বাধীন ডিবির একটি দল।
তবে ১ কোটি ২০ লাখ টাকার বিনিময়ে ঘটনাস্থলেই তিন ইয়াবা কারবারিকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এ অপরাধ আড়াল করতে অভিযানস্থল হিসেবে চকরিয়া থানাধীন ডুলাহাজারা ইউনিয়ন দেখানো হয়। সেখানে ১ লাখ ৪০ হাজার ইয়াবা উদ্ধার এবং গাড়ির চালক ইসমাইলকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে চকরিয়া থানায় মামলা (নম্বর-১৬) দায়ের করা হয়। মামলার বাদী করা হয় এসআই সমীর গুহকে।
নিয়ম অনুযায়ী, জব্দ করা গাড়ি চকরিয়া থানায় হস্তান্তর করার কথা থাকলেও, তা জেলা পুলিশ লাইন্সে নিয়ে যাওয়া হয়। সূত্র জানায়, ইয়াবা আত্মসাতের পুরো পরিকল্পনা পুলিশ সুপার মো. রহমত উল্লাহর সঙ্গে সমন্বয় করেই করা হয়। তবে তিনি এই ঘটনায় মাত্র ৩০ লাখ টাকা পেয়েছেন।
মিয়ানমারে সেনাবাহিনী ও বিদ্রোহীদের মধ্যে সংঘাত চলমান থাকলেও, সেখান থেকে বাংলাদেশে গরু-মহিষের চোরাচালান থামছে না। প্রতিদিন কক্সবাজারের রামু ও নাইক্ষ্যংছড়ির ভালোবাসা, কম্বনিয়া, তুমব্রু, বাম হাতিরছড়া, ফুলতলী, চাকঢালা, লম্বাশিয়া, ভাল্লুকখাইয়া, দৌছড়ি, বাইশফাঁড়ি, আশারতলী, জামছড়ি, হাজিরপাড়া, মৌলভীরকাটা—এসব পয়েন্ট দিয়ে শত শত গরু-মহিষ অবৈধভাবে দেশে প্রবেশ করছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, চোরাচালানের পথে কোনো বাধা সৃষ্টি না করার শর্তে প্রতিটি গরুর বিপরীতে পুলিশকে এক হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়। প্রতিদিন গড়ে ৩০০ থেকে ৩৫০ গরু প্রবেশ করায়, চাঁদাবাজির পরিমাণ দাঁড়ায় তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা। মাসে এই চাঁদার পরিমাণ এক কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। পুলিশের পক্ষ থেকে এই টাকা সংগ্রহের দায়িত্বে রয়েছেন নির্দিষ্ট কয়েকজন সোর্স, যাদের কার্যক্রম তদারকি করে গর্জনিয়া পুলিশ ফাঁড়ি।
এ বিষয়ে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. রহমত উল্লাহকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘এসব অভিযোগ সত্য কিনা আপনার কী মনে হয়?’
এদিকে, যশোরের পুলিশ সুপার জিয়াউদ্দিন আহমেদকে সাড়ে ছয় মাস পর প্রত্যাহার করা হয়েছে। তার তাৎক্ষণিক প্রত্যাহারের পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ আলোচনায় এসেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা হলো, গত রোববার মণিরামপুর থানায় গ্রেপ্তার আসামিদের টাকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগ। এ ঘটনায় থানায় হামলা, ভাঙচুর, মামলা ও নতুন করে গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটে।
এছাড়া, জেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি এবং স্বর্ণ চোরাচালানের লাগামহীন বিস্তারকেও তার প্রত্যাহারের অন্যতম কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
২০২৪ সালের ৩১ আগস্ট যশোরের পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্ব নেন ডিএমপির অতিরিক্ত উপকমিশনার জিয়াউদ্দিন আহমেদ। তার সময়ে যশোরে অপরাধ বৃদ্ধি পেয়েছে। চাঁদাবাজি, খুন, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাইয়ের মতো অপরাধ বেড়ে যাওয়ায় জনজীবনে আতঙ্ক নেমে এসেছে।
পুলিশের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ ক্রমশ বাড়ছিল। সর্বশেষ, রোববার মনিরামপুরে মাদকসহ আটক চার আসামিকে টাকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনায় উপজেলা বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা মনিরামপুর থানার ওসিসহ কয়েকজন উপপরিদর্শকের অপসারণের দাবিতে থানার ফটকে বিক্ষোভ করেন।
বিক্ষোভকারীদের দাবি, পুলিশ সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে অপরাধীদের গ্রেপ্তার করলেও, রহস্যজনক কারণে আদালতে সোপর্দ না করে থানার ভেতরেই ছেড়ে দিচ্ছে। তারা বলেন, চিহ্নিত অপরাধীদের মুক্তি দেওয়া ফ্যাসিস্ট শক্তির সহযোগিতা ছাড়া কিছু নয়, এবং এর পেছনে পুলিশের অর্থ বাণিজ্য জড়িত।
এছাড়া, গত বছরের জুলাই থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত যশোরে ৫০টির বেশি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। যদিও প্রতিটি ঘটনার আসামি শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে, তবে পুলিশ হত্যাগুলো প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ। একই সময়ে জেলায় ১৫টি ডাকাতি ও অন্তত ৩০টি বড় চুরির ঘটনা ঘটে, যার কোনো কূলকিনারা করতে পারেনি পুলিশ। লুট হওয়া অর্থ ও মালপত্র উদ্ধার হয়নি, ফলে স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক বেড়েছে।
পুলিশের ভূমিকা নিয়ে নানা মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিনিয়ত জেলা শহরে চুরি, ছিনতাই ও ছুরিকাঘাতের ঘটনা ঘটছে। সন্ধ্যার পর অনেক বাসিন্দা বাইরে বের হতে ভয় পাচ্ছেন। ফলে আইনশৃঙ্খলার অবনতি নিয়ে পুলিশের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে যশোর সীমান্তে স্বর্ণ চোরাচালান ব্যাপকভাবে বেড়েছে। পুলিশের একাংশ এই চোরাচালান সিন্ডিকেটের সঙ্গে আঁতাত করে সুবিধা দিচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তে বিষয়টি উঠে আসার পর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়। এই কারণটিও পুলিশ সুপারকে প্রত্যাহারের পেছনে ভূমিকা রেখেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
যশোর পৌর নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব ও বাম নেতা জিল্লুর রহমান ভিটু বলেন, "যশোরে আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি হয়েছে। প্রতিদিন ছুরিকাঘাত, ডাকাতি, ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। দখলবাজি চলছে। অনেক ডাকাতির ঘটনা ঘটলেও, কোনো রহস্য উদ্ঘাটিত হয়নি। প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে বিশেষ মতাদর্শের লোকদের বসানো হচ্ছে। আমাদের ধারণা, আইনশৃঙ্খলার উন্নতি না হওয়ার কারণেই পুলিশ সুপারকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।"
এদিকে, নীলফামারীর পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মোর্শেদ আলমকেও সোমবার প্রত্যাহার করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম ও অসৌজন্যমূলক আচরণের অভিযোগ ছিল। এছাড়া, জেলায় চুরি, ছিনতাই ও মাদক ব্যবসা বেড়ে যাওয়ায় তার প্রশাসনিক কার্যক্রম নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়।
No comments